পুলিশ-প্রশাসন সংস্কারের দাবিতে নতুন প্ল্যাটফর্মের আত্মপ্রকাশ চট্টগ্রামে, ওসি জায়েদকে বহিষ্কারের দাবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর পটিয়া থানা পুলিশের হামলার পর ওসির আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরকে প্রত্যাহার করা হলেও সন্তুষ্ট নন আন্দোলনকারীরা। পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সার্বিক সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রামে তারা ‘পুলিশ-প্রশাসন সংস্কার আন্দোলন’ নামে নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) পার্শ্ববর্তী চন্দনাইশ থানার ওসি (তদন্ত) যুযুৎ যশ চাকমা পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। এরপরই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও সহযোগী সংগঠনগুলো বিকেলে নগরীর ষোলশহরে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক জোবেইরুল হাসান আরিফ এ সংবাদ সম্মেলনে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং স্থায়ীভাবে প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভের ঘোষণা দেন।
এ সময় এনসিপির নেতা বলেন, চট্টগ্রামের এসপিকে অপসারণ করার কথা আমরা বলেছিলাম এবং পুলিশ সংস্কার বিষয়ক একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া। আমরা বলেছিলাম, এখন থেকে কোনো থানায় যদি চিহ্নিত কোনো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগকে যদি সন্ত্রাসী হিসেবে আমরা পরিচয় করিয়ে দিই এবং তাকে যদি পুলিশ গ্রেপ্তার না করে, এ ব্যাপারে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে সুস্পষ্টভাবে আইনি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে, এ দাবিগুলো আমরা উপস্থাপন করেছিলাম। আমরা দেখেছি, তারা প্রহসনের মতো করে এক ধরনের প্রমশনের ব্যবস্থা করেছেন পটিয়ার ওসিকে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানে ‘আত্মপ্রকাশ’ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। আয়োজকেরা মিছিলটিকে ‘সংস্কার সংগ্রামের প্রথম রাজপথিক সওয়ার’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
এনসিপির চট্টগ্রাম মিডিয়া সেলের মুখপাত্র আরফাত আহমেদ রনি বলেন, এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, হেফাজতে ইসলাম, এনসিপি, যুবশক্তি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, ইসলামিক দাওয়াহ মুভমেন্ট, এসএডি, পুনাব, পুসাব, জুলাই ঐক্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ছাত্র-যুব সংগঠন।
তিনি আরও বলেন, এই প্ল্যাটফর্ম চার দফা মূল দাবির ভিত্তিতে কাজ করবে। পুলিশ ও প্রশাসনে সীমাহীন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দলীয় প্রভাব চলে আসছে, যা জাতীয় নিরাপত্তা এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এখন সময় এসেছে বাস্তব সংস্কারের। যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংস্কারে ব্যর্থ হয়, তবে রাজপথ থেকেই আমরা চূড়ান্ত বাস্তব সংস্কারের সংগ্রাম চালিয়ে যাব।
আরও বলা হয়, আমরা যখন পটিয়া থানায় ছাত্রলীগকে ধরিয়ে দিতে যাই, পটিয়া থানা আমাদের মব বলে আমাদের উপর টর্চার চালায় এবং আমাদের অনেক ভাইদের আহত করে। তারা হসপিটালে কাতরাচ্ছে থানায় মামলা নিচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা পুলিশ সংস্কার আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবার রাত ৮টায় রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দীপঙ্কর দে’কে পটিয়ার শহীদ মিনার এলাকা থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপির নেতাকর্মীরা। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে অস্বীকৃতি জানালে এনিয়ে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ওসির নেতৃত্বে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে ছাত্রদের উপর। এসময় ১০ জন ছাত্র আহত হন।
এরপর রাত সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এসে ২য় দফায় আবারো লাঠিপেটায় অন্তত আরো ১৫ জন জন আহত হন। আহতদের মধ্যে অনেকেই এখনো চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
পুলিশের দুই দফা লাঠিপেটার জের ধরে বুধবার সকাল ১০টা প্রথম দফা পটিয়া থানা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে আন্দোলনরত ছাত্ররা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল পটিয়া পৌর সদর প্রদক্ষিণ করে চট্টগ্রাম পটিয়া কক্সবাজার মহাসড়কের বাইপাস এলাকায় গিয়ে মহাসড়কে বসে পড়ে সড়ক অবরোধ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। পরে মহাসড়কের ওপর টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ফলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে।
একইদিন দুপুরে দ্বিতীয় দফায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম নগরীতেও। এনসিপির নেতাকর্মীরা সরাসরি চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের সামনে হাজির হয়ে দাবি জানান—ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশকে নিচে নেমে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। কিন্তু ডিআইজি পাঁচজন প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠালে আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে খুলশী থানার ৪ নম্বর সড়কে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে মূল জাকির হোসেন রোডও অবরোধ করে ফেলেন তারা।
পুলিশের পরিদর্শক আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরসহ পটিয়া থানার তিন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহারের আশ্বাস পাওয়ার পর বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় আন্দোলন থেকে সাময়িকভাবে সরে আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীরা।
এরপর চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম জানান, আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত ওসি হিসেবে দায়িত্ব দেন পুলিশ পরিদর্শক যুযুৎ যশ চাকমা।
পুলিশ সংস্কারের জন্য আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, বীর চট্টলার ক্যান্টনমেন্ট খ্যাত ষোলশহর থেকে পুলিশ সংস্কারের আন্দোলনের ঘোষণা করছি। আমরা বিশ্বাস করি, পুলিশে যারা আছেন, তাদের অনেকে সংস্কার চান। পুলিশ ভাইদের বলব—আপনারা আমাদের ভাই, আমরা চাই, আপনারাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের সঙ্গে রাজপথে আসবেন। আপনারা আপনাদের জায়গা থেকে আমাদের সঙ্গে সংহতি জানাবেন। আমরা সবাই মিলে পুলিশ সংস্কার করব এবং জুলাই বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করব।
তিনি আরও বলেন,পটিয়ার ওসি আমাদের সহযোদ্ধাদের হামলা করে আহত করেছে। আমরা দাবি জানিয়েছিলাম, সেই ওসিকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, প্রশাসন আমাদের সঙ্গে প্রহসন করেছে। পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, পটিয়ার ওসিকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের যেসব ভাইয়েরা আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার দায়ভার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। শুধুমাত্র বদলি-বদলি খেলা করে পুলিশ সংস্কার সম্ভব নয়।
ডিজে