রমরমা/ পুলিশ পাহারায় মদ-জুয়ার আসর ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায়
মাসে আয় অন্তত ৩০ লাখ টাকা
অনিয়মই এখানে নিয়ম! চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশন এবং জিআরপি থানা সংলগ্ন এলাকায় রেলপুলিশের পাহারায় প্রকাশ্যে বসছে জুয়া ও গাঁজার আসর। জুয়ার আসর ও মাদকের বেচাকেনায় মাসে আয় অন্তত ৩০ লাখ টাকা। ষোলশহর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বে থাকা ইনচার্জের দিকেই অভিযোগের যতো তীর। ভাগাভাগিতে পিছিয়ে নেই পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষও।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, জিআরপি পুলিশের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যাওয়ার কারণে ষোলশহর রেলস্টেশন এবং জিআরপি থানা সংলগ্ন চারপাশ অপরাধীদের অভয়ারণ্য ও মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
দোকানে দোকানে মদ-জুয়ার আসর
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, থানা সংলগ্ন রেলের জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে বসেছে ছোট ছোট অন্তত ৫০টি দোকান। ১৫টি চায়ের দোকানে রয়েছে একটা টেলিভিশন আর ক্যারম বোর্ড। প্ল্যাটফর্মে থাকা দোকানগুলোর মাঝেও কয়েকটি অবৈধ। ১২টি দোকানে তিন থেকে চারটি বোর্ডে বসে ক্যারম খেলার নামে জুয়ার আসর। প্রতি খেলায় জনপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকার বাজি ধরে খেলেন জুয়াড়িরা। একটা দোকান থেকেই একবেলায় আসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। কখনও কখনও তারও বেশি। খেলা চলে সকাল থেকে রাত অবধি। রমজানের মদ আর জুয়ার আসর থেকে আসে প্রতিদিন দুই থেকে তিন লাখ টাকা। প্রতিমাসে সবমিলিয়ে অন্তত ৩০ লাখ টাকা আসে এসব আসর থেকে। এর একভাগ যায় পুলিশের পেটে। আরেক ভাগ যায় পুলিশের উর্ধতন এক কর্মকর্তার কাছে। এভাবেই বছরের পর বছর পুলিশি পাহারায় প্রকাশ্যে চলে অপরাধের অবাধ বিস্তার।
পুলিশ ফাঁড়ির পিছনে বশর কলোনিতে বসে রমজানের জুয়ার আসর। দুই-তিন রুমে প্রায় শ’খানেক লোকের আনাগোনায় চলে খেলা। পাশাপাশি স্টেশন সংলগ্ন জিআরপি থানার পাশে রেলওয়ে শ্রমিক লীগের অফিসে দিন-রাত চলছে লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা। জুয়ার আসর জমাতে চলে মাদক সেবন। এসব খেলার একটি অংশের ভাগ দিতে হয় ষোলশহর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জাকির হোসেনকে।
‘একসাথেই আসর জমায় পুলিশ’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি জানান, ‘খেলা তো আর এমনি এমনি হয় না। বললে সমস্যা আছে। কিন্তু না বলেও পারছি না। এই টাকার ভাগ তাগোরে না দিলে তো খেলতে পারবো না। বড় অংশই পেটে ভরে। খোঁজ নেন, পাইয়া যাবেন।’
আরেক দোকানি বলেন, ‘রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের ভেতরেই ঘোরাফেরা অপরাধীদের। পিচ্চিপাচ্চা যে কাউরে বললেই দেখিয়ে দেবে আসর।’ তাচ্ছিল্যের সুরে তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ এদের ধরার বদলে একসাথেই আসর জমায়। ওই যে কথায় আছে না রক্ষক যখন ভক্ষক।’
দোকানির সাথে কথা বলা অবস্থায় দোকানে আসা রিকশাচালক শামসুল আলম বললেন, ‘আমি পাশের এলাকায় থাকি। সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে এখানে আসি। একদিন না বহুদিন আমিও খেলছি। এটা নেশা হইয়া গেছে। বউয়ের ডরে ছাইড়া দিছি। আমিও বহুদিন দেখছি পুলিশগুলা টাকা নেয়। নজরে রাখেন। সব জলের মতো ক্লিয়ার দেখবেন।’
পথচারী শরফুদ্দিন বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বখাটে ছেলেপেলেদের আড্ডাখানা পুরো রেলস্টেশন। এরাই জুয়া খেলে।’
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হোসেন এর বিরোধিতা করে বলেন, ‘লুঙ্গি পরে কি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা এই জায়গায় আসবে ক্যারম খেলতে? শিক্ষার্থীরা এই পথ ব্যবহার করে বলেই একরকম জোর করে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
অভিযোগের তীর ফাঁড়ি ইনচার্জের দিকে, রক্ষক ওপরে
চার বছর ধরেই আধিপত্য বিস্তার করে দাপটের সাথে ফাঁড়ি ইনচার্জের দায়িত্ব নিয়ে আছেন জাকির হোসেন। যদিও নিয়ম অনুযায়ী একজন ফাঁড়ি ইনচার্জ দুই বছরের বেশি সময় একটি জায়গায় থাকতে পারেন না। অভিযোগ রয়েছে, মদ ও জুয়ার আসর থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতবদল হয়ে যায় ইনচার্জ জাকির হোসেনের কাছে। আর সেই টাকারই এক ভাগ চলে যায় তার উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে। সে কারণে দায়িত্বে অবহেলা হোক কিংবা মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা হোক—সবকিছুতেই পার পেয়ে যান জাকির হোসেন। ফাাঁড়িসূত্রে জানা যায়, দিনের বেশিরভাগ সময় জাকির হোসেন কর্মস্থলে থাকেন না। সন্ধ্যায় একফাঁকে এসে কেবল হাজিরা দিয়েই আবারও গায়েব হয়ে যান পুলিশ সুপারের বাংলোতে।
জুয়ার আসর থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগের পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলা নিয়েও অনেক অভিযোগ রয়েছে জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে। গত ৭ জুন হামজারবাগ রেলগেইটে কাটা পড়েন মরিয়ম খাতুন (৬০) নামের এক মহিলা। সে সময় ইনচার্জ ঈদের ছুটিতে ছিলেন। দুই দিনের ছুটির কথা বলে পাঁচদিন কর্মস্থলে ছিলেন না। পরবর্তীতে এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি নিজেই ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে দাবি করেন। কিন্তু নিহত মরিয়ম খাতুনের পরিবার দাবি করেছেন, ঈদের ছুটি থাকায় জিআরপি থানা পুলিশের কেউই ঘটনাস্থলে ছিলেন না।
দায়িত্বে অবহেলা প্রসঙ্গে জাকির হোসেনের পক্ষ নেন রেলওয়ে পুলিশ সুপার নওরোজ হোসেন তালুকদার। তিনি বলেন, ‘আসলে উনি বাড়তি ছুটি কাটান নাই। উনার পরিবারের সমস্যা ছিল বলেই আমাকে জানিয়ে তারপর ছুটি কাটিয়েছেন।’
বক্তব্য অভিন্ন
জুয়ার আসর নিয়ে জানতে চাইলে ফাঁড়ির ইনচার্জ জাকির হোসেন বলেন, ‘আগে হতো শুনেছি। তবে এখন হয় না।’
আপনিই এই চক্রের সাথে জড়িত—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আজকেই জানলাম আপনার কাছ থেকে। আমি এসবের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলি। এমন অভিযোগ সত্য নয়।’
মদ ও জুয়ার আসর নিয়ে একই বক্তব্য রেলওয়ে পুলিশ সুপারেরও। তিনিও মদ-জুয়ার আসর নিয়ে কিছু জানতেন না বলে দাবি করেন। তবে তার ভিন্ন বক্তব্য ফাঁড়ি ইনচার্জকে নিয়ে। চার বছর ধরে তিনি কিভাবে একই জায়গায় বহাল তবিয়তে রয়েছেন—সে প্রসঙ্গে রেলওয়ে পুলিশ সুপার নওরোজ হোসেন তালুকদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে এসব ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত লোকের অভাব। তাছাড়া তিনি খুবই পরিচিত এবং স্টুডেন্টদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে। যেকোনো ঝামেলার সহজ সমাধান করতে পারেন—তাই আছেন আর কী।’