পুলিশের ‘আদরে’ ষোলশহর রেলস্টেশনে মাদক থেকে জুয়া, ছিনতাই থেকে যৌনবাণিজ্যের রমরমা
পাঁচলাইশ থানায় নিয়মিত যায় মোটা অংকের টাকা
চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে দিনের বেলা বাতাসে ওড়ে মদ-গাঁজা-হিরোইন-ইয়াবার গন্ধ। খোদ পাঁচলাইশ থানা পুলিশের যোগসাজশে এই অপকর্ম চলছে দিন-রাত। মাসোহারা যাচ্ছে পুলিশের পকেটেও। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে এই ব্যবসায়ে জড়িত অন্তত ৫০ লোক। এদের অধিকাংশই যুবক, নারী ও শিশু। পুলিশে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা রেলস্টেশনে সুযোগ বুঝে ছিনতাইয়েও জড়িয়ে পড়ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশন যেন এক ভিন্ন জগৎ। যেখানে মাদক ব্যবসা, জুয়ার আসর, চুরি, ছিনতাই, সুন্দরী রমনীর রঙ্গমঞ্চ—সবই মেলে হাতের নাগালে। আবার অলিগলিতে রয়েছে সুন্দরী রমণীর প্রতারণার ফাঁদও। সাধারণ মানুষের পথচলা সেখানে আতঙ্কের। পুলিশের আনাগোনা সেই এলাকায় নেই বললেই চলে। কারণ অপরাধীদের সঙ্গে স্থানীয় থানা পুলিশের রয়েছে মধুর সম্পর্ক। এই অপরাধকে পুঁজি করে গড়ে ওঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
অভিযোগ রয়েছে, সিএমপির পাঁচলাইশ থানা পুলিশের সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে এই অপরাধ সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় প্রকাশ্যই চলছে মাদক বিক্রি ও সেবন, জুয়া, ভাসমান পতিতাবৃত্তি। ঘনবসতিপূর্ণ স্থান হওয়ায় এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে ছয় যুবকের এক অপরাধ সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে মো. সবুজ ওরফে কানা সবুজ, জাহেদ, মহসিন, রুবেল, ইমন ও হেলাল।
জানা গেছে, স্টেশন এলাকায় মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন সবুজ ওরফে কানা সবুজ। জাহেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জুয়ার আসর, মহসিন করেন ভাসমান পতিতাদের রঙ্গমঞ্চের দেখাশোনা। এছাড়া রুবেল ও ইমনের নিয়ন্ত্রণ করেন জুয়া। আর ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত হেলাল। আবার এদের এই সিন্ডিকেটের গডফাদার কানা সবুজ। তারই হাত ধরেই টাকা যায় থানা পুলিশের পকেটে।
সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে মো. সবুজ ওরফে কানা সবুজের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, থানা পুলিশ আমাদের হাতে আছে। এই এলাকায় পুলিশ ভুলেও আসে না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। কি লাগবে শুধু বলুন, নারী-মদ-জুয়া, সবই এখানে হালাল।
এদিকে টং দোকান থেকে শুরু করে অলিগলির প্রায় দোকানে সরাসরি মাদক বিক্রির ‘বৈধতা’ আছে বলেও জানান কানা সবুজ।
স্টেশন এলাকার চা দোকানদার আবুল হাশেম বলেন, ‘আপনার কি লাগবে বলুন। টাকা দিলেই এনে দেব।’
পুলিশের ভয় আছে কি-না, এমন প্রশ্নের উত্তরে দোকানি বলেন, ‘পুলিশের লোক এসে দৈনিক প্রতিটি স্পট থেকে চাঁদা নিয়ে যায়। আবার মাসিক মোটা অংকের মাসোহারাও দিতে হয় পাঁচলাইশ থানা পুলিশকে।’
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ছয় যুবকের সেই সিন্ডিকেটের রয়েছে, সুন্দরী রমনী দেখিয়ে খদ্দেরদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতানোর ছক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গার্মেন্টসকর্মী বলেন, ‘প্রথমে সুন্দরী রমণীদের দেখিয়ে দাম কষাকষি চলে দীর্ঘ সময় ধরে। এরপর রুমে নিয়ে আপত্তিকর ছবি তুলে জিম্মি করা হয়। পরে মোটা অংকের টাকা দাবি করে আমার থেকে। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে, একটু পরে হাজির হয় হাতে ওয়াকিটকি ও কোমরে হ্যান্ডকাফ নিয়ে দুই পুলিশ। তারা পরিচয় দেয় পাঁচলাইশ থানায় কর্মরত হিসেবে। এরপরই ভয়ভীতি দেখিয়ে ২০ হাজার টাকা আদায় করে তারা।’
এদিকে মেয়র গলি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা অলিউল্লাহ বলেন, ‘থানার পুলিশ মনে হয় এই স্টেশন চেনে না। স্টেশন এলাকায় প্রকাশ্যই এমন অপরাধ, তাও আবার একটি শহর অঞ্চলে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘মাদককারবারিদের কালো টাকায় থানা পুলিশ টিনের চশমা পড়ে আছে। তাই প্রকাশ্য এমন অপরাধ কখনোই চোখে পড়বে না তাদের।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেদকের ওপর ক্ষেপে যান পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে অপরাধীদের সরাসরি যোগসাজশ আছে, আপনি এটি পত্রিকায় লিখে দেন।’ এরপর তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
আরএন/ডিজে