পাহাড় কেটে ঝিরি ভরাট করছেন নারী ভাইস-চেয়ারম্যান, জানেন না কাপ্তাইয়ের ইউএনও

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা থামছেই না। পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাব পড়ার পরও গোপনে-প্রকাশ্যে নির্বিচারে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞ চলছে অহরহ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পাহাড় কাটায় জড়িয়ে পড়ছেন খোদ জনপ্রতিনিধিরাও।

পাহাড় কেটে ঝিরি ভরাট করছেন নারী ভাইস-চেয়ারম্যান, জানেন না কাপ্তাইয়ের ইউএনও 1

এবার রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান উমেচিং মারমার বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে ঝিরি ভরাটের অভিযোগ ওঠেছে। তবে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানের পাহাড় কাটার বিষয়টি জানেই না প্রশাসন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের শীলছড়িতে নারী ভাইস চেয়ারম্যানের নিজ বসতঘরের পাশেই পাহাড় কাটার কাজ চলছে। পাহাড়ের মাটি একটি ট্রাকে করে কয়েক দফায় সরিয়ে নেওয়া হলেও কোথায় নেওয়া হয়েছে, সেটি স্থানীয়সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। আর বাকি মাটি স্থানীয় শীলছড়ি ঝিরির পাশঘেঁষেই ঝিরি ভরাটের জন্য ফেলা হচ্ছে।

মূলত ঝিরি ভরাট করে দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই মাটি ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বরইছড়ি-কাপ্তাই নতুনবাজার সড়কের পাশেই শীলছড়ি ক্লাবের পাশঘেঁষে একটি গ্রামীণ কাঁচা সড়ক গেছে। এই সড়কে প্রবেশের ডান পাশেই রয়েছে একটি লাল রঙের এক্সকেভেটর। এক্সকেভেটরের পেছনেই পাহাড়ি ঝিরি পাশেই মাটি ফেলা হয়েছে, যেসব মাটি আনা হয়েছে পাহাড় কেটে।

Yakub Group

এই সড়ক ধরে ৫০০ মিটার হাঁটার পর দেখা মিলল পাহাড় কাটার চিত্র। উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান উমেচিং মারমার ঘরের পাশেই আস্ত পাহাড়টির অর্ধেকের বেশি অংশ কাটা হয়ে গেছে। নব্বই ডিগ্রি কাটা পাহাড়ের বুকে রয়ে গেছে এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি কাটার চিহ্ন।

ঘটনাস্থলে প্রতিবেদকের উপস্থিতির মুহুর্তের মধ্যে এক্সকেভেটরটি সেই স্থান থেকে সরিয়ে বরইছড়ি-কাপ্তাই সড়কের পাশে এনে রাখা হয়। পাহাড়ের মাটি কাটার শুরুর দিকে একটি বুলডোজার থাকলেও সেটি ঘটনাস্থলে গিয়ে পাওয়া যায়নি।

বুধবার (১৮ জানুয়ারি) বিকালে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঝিরির পাশে ফেলা মাটি টেনে তোলার কাজ করছে ভাইস চেয়ারম্যানের লোকজন।

এদিকে পাহাড়ের ছবি তোলার সময় এগিয়ে আসেন উমেচিং মারমার মেয়ের জামাই মংচাই মারমা। মংচাই মারমা জানান, পাহাড় কাটার স্থানে ঘরবাড়ি করার উদ্দেশ্যে তারা পাহাড়টি কাটছেন। যেটুকু কাটা হয়েছে এরপর আর তারা পাহাড় কাটবেন না।

তবে স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, মূলত ঘরবাড়ি নির্মাণের উদ্দেশ্যে পাহাড় কাটার কথা বলা হলেও পাহাড়ের মাটি ফেলা হচ্ছে ঝিরির পাশের ঢালু অংশে। এতে করে ঝিরি সংকুচিত করে ভরাটের পর বেদখলের চেষ্টা চলছে। জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই অবৈধভাবে ঝিরি ভরাট করছে।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় শীলছড়ি ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে ঝিরি অবস্থাও মৃতপ্রায়। বছরের শুষ্ক মৌসুমের ঝিরিতে পানি থাকে না। এ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতায় এটি নামেই ঝিরিতে পরিণত হয়েছে।

এরমধ্যে মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) সেই ঝিরির পাশের শীলছড়ি ক্লাবে দুপুরে ওএমএসের চাল বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শনে আসেন কাপ্তাইয়ের ইউএনও মুনতাসির জাহান। এ সময় তার সঙ্গে রাঙামাটি প্রাক্তন জেলা প্রশাসক ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব একেএম মামুনুর রশিদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা ছিলেন।

ক্লাবের পাশে পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে ঝিরি ভরাটের কাজ চললেও বিষয়টি জানেন না বলে জানান ইউএনও।

কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান উমেচিং মারমা দলীয়ভাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। এর আগে তিনি একাধিকবার উপজেলার ৫ নম্বর ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য ছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান উমেচিং মারমা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় প্রশাসন জেনেও নির্লিপ্ততার ভূমিকা নিয়েছে।

পরিবেশবাদীদের মতে, কখনও উন্নয়নের নামে, কখনও প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিদের পাহাড় কাটা থামানো না গেলে পাহাড়ে পরিবেশের আরও বিপর্যয় ঘটবে। অবিলম্বে প্রশাসনকে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমে প্রতিরোধ কার্যক্রম উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

পাহাড় কাটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান উমেচিং মারমা বলেন, ‘আমার মেয়ের জামাই ঘর করার জন্য উঁচু-নিচু টিলা সমান করেছেন। ওইভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে না, আর মাটিগুলো আমাদের বাগানে ও পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলা হচ্ছে।’

ঝিরি ভরাট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাটিগুলো যখন ফেলা হয়েছে, তখন আমি ছিলাম না। ঝিরির পাশে যে মাটিগুলো ফেলা হয়েছে, সেগুলো টেনে তোলা হচ্ছে।’

কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহান বলেন, ‘প্রশাসন কাউকে মাটি বা পাহাড় কাটার অনুমতি দেয় না। উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস-চেয়ারম্যানের পাহাড় কাটার খবরটি আমাদের জানা নেই।’

ঝিরি পাশে মাটি ভরাটের বিষয়টি দেখেছেন কি-না জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে স্যাররা এসেছেন, উনাদের নিয়ে চাল বিতরণ কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়েছি। অন্যদিকে খেয়াল করিনি, তাই বিষয়টি চোখে পড়েনি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!