পানি বিশুদ্ধ করার ‘বাজেট’ নেই চট্টগ্রাম ওয়াসার, লবণ পানিতে বাড়ছে রোগ
খরচের ভয়ে ব্লেন্ডিং হচ্ছে এক নদী থেকে অন্য নদীতে
চট্টগ্রামে ওয়াসার পানিতে কাটছে না লবণাক্ততা। খরচের ভয়ে রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ার বদলে এক নদীর পানি অন্য নদীতে ব্লেন্ডিং করে নগরবাসীকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে প্রতি লিটারে অন্তত ৪০০ মিলিগ্রামের ওপর লবণ থাকে পানিতে। আর এসব লবণ পানি খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতে মানুষের শারীরিক জটিলতাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
অথচ ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা বাজেট করা হলেও খাবার পানি লবণমুক্ত করতে কোনো ধরনের বাজেট রাখা হয়নি।
জানা গেছে, খাবার পানি লবণমুক্ত করতে রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় শতভাগ লবণমুক্ত করতে হয়। কিন্তু তাতে খরচ বেশি। প্রতি লিটার পানি রিভার্স অসমোসিস করতে ৮০ থেকে ৯০ টাকা খরচ পড়ে। এই খরচ বহন করা ওয়াসার জন্য দুরূহ। আর বর্তমান ব্লেন্ডিং প্রক্রিয়ায় পানি উৎপাদনে খরচ পড়ছে ২৫ থেকে ২৬ টাকা।
রিভার্স অসমোসিস সিস্টেমে কোনো ধরনের তাপ উৎপাদন ছাড়াই পানিকে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পানি বিশুদ্ধ করার পর পানিতে অপ্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকে না, যা আমাদের কিডনির ওপর অনেক চাপ কমিয়ে দেয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে দৈনিক পানির চাহিদা ৪৬ থেকে ৪৮ কোটি লিটার। বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার চারটি পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ৪৭ কোটি লিটার পানি। আরও একটি পানি শোধনাগার প্রকল্প নির্মাণকাজ চলছে।
এর মধ্যে রাঙ্গুনিয়া পানি শোধনাগার ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ থেকে দৈনিক পাওয়া যায় ২৮ দশমিক ৬ কোটি লিটার পানি। মদুনাঘাট পানি শোধনাগার থেকে পাওয়া যায় ৯ কোটি লিটার এবং মোহরা পানি শোধনাগার থেকে পাওয়া যায় আরও ৯ কোটি লিটার।
এক নদী থেকে আরেক নদীতে ব্লেন্ডিং করার পরও ওয়াসার খাবার পানির প্রতি লিটারে ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিগ্রাম লবণ থাকছে।
এদিকে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পের উৎস থেকে পানি সংগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে মোহরা পানি শোধনাগার থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে ৭ কোটি থেকে ৮ কোটি লিটার পানি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘লবণ পানি থেকে সহসা মুক্তি নেই নগরবাসীর। কারণ কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি কম ছাড়ায় হালদা নদীতে মিঠা পানির পরিমাণ কমে গেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির বৃহৎ উৎস হালদা নদী। কিন্তু পানি কমে যাওয়ায় রাঙ্গুনিয়ার কর্নফুলীর পানি ব্লেন্ডিং করে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু কর্নফুলী নদীতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় পানি লবণাক্ত হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সমস্যার সমাধান মিলতো যদি পানি রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় পানি শতভাগ লবণমুক্ত করা যেত। কিন্তু তাতে খরচ বেশি। প্রতি লিটার পানি রিভার্স অসমোসিস করতে ৮০ থেকে ৯০ টাকা খরচ হবে। এই খরচ বহন করা ওয়াসার পক্ষে সম্ভব না। বর্তমানে ওয়াসার সুপেয় পানি উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ২৬ টাকা।’
রিভার্স অসমোসিসের জন্য কোনো ফান্ড না রাখা প্রসঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘অবশ্যই রিভার্স অসমোসিস বাবদ ফান্ড ওয়াসার রাখা উচিত ছিল। ওয়াসাকে পানি সরবরাহের পাশাপাশি প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাড়তি ফান্ড রাখা উচিত। শুষ্ক মৌসুম দীর্ঘায়িত হলে এই সংকট আরও প্রকট হবে।’
এদিকে নগরীতে ওয়াসার লবণ পানি পান করে অনেকেই পেটের পীড়াসহ নানা রোগে ভুগতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের এই পানি পান করে শারীরিক জটিলতা বেড়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি বহির্বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৫০ জন রোগী আসলেও বর্তমানে তা ২৫০ থেকে ৩০০ তে গিয়ে ঠেকছে।
বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর কাট্টলী, হালিশহর, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, বড়পুল, সিটিগেট, আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাটের রোগী বেশি। মূলত এসব এলাকার মানুষকেই লবণ পানি খেতে হচ্ছে।
রোববার (১২ মার্চ) কিডনি বহির্বিভাগে কথা হয় বহদ্দারহাটের ফরিদাপাড়ার বাসিন্দা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি হাইপ্রেসারে আক্রান্ত। কিডনি জটিলতা তার ছিল না। কিন্তু একমাসের কিছু কম সময় ধরে তারা তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, প্রস্রাবের বেগ পায়। প্রস্রাবে ফেনা চলে আসছে, হাত-পা ফুলে গেছে। প্রায় দেড় মাস ধরে তার এলাকায় ওয়াসার পানিতে লবন আসছে। কয়েকদিন মিনারেল ওয়াটার কিনে খেলেও এখন সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।
কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. প্রদীপ দত্ত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিডনি রোগীদের লবণ পরিহার করতে বলা হয়। কিন্তু সেই রোগী যদি প্রতিদিন ৩ লিটার পানি পান করে, তাহলে তার শরীরে মাত্রাতিরিক্ত লবণের যোগান হচ্ছে। যার ফলে যারা কিডনি উপসর্গে ছিলেন, তারাও পুরোপুরি কিডনি রোগী হয়ে যাচ্ছেন। শারীরিক জটিলতা বাড়ছে।’
ডিজে