পাতানো ফাঁদে প্রতারক ‘ব্যারিস্টার’ ধরা পড়ল যেভাবে

কখনও তার পরিচয় ‘ব্যারিস্টার’, কখনও বা আবার ‘সাংবাদিক’। যখন যে পরিচয় কাজে লাগে, সেটা ব্যবহার করেন। ভিজিটিং কার্ডে তার নামের আগে শোভা পায় ‘ব্যারিস্টার’ উপাধি, আর নামের শেষে সাংবাদিক, লেখক, পত্রিকা সম্পাদকের বাহারি সব পরিচয়।

আদতে এসবের কিছুই নন তিনি। এসব ভুয়া পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায় অসহায় মানুষ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এটাই তার পেশা। নাম তার কামরুল ইসলাম হৃদয়।

ব্যারিস্টার সেজে মামলা থেকে আসামিকে জামিন বা খালাস করার চুক্তিও করেন সুযোগ বুঝে। আবার সাংবাদিক সেজে টাকার বিনিময়ে খবর ছাপানোর টোপও দেন। এসব কারণে আদালতপাড়ায় তার পরিচয় ছিল ‘সর্বরোগের মহৌষধ’। শেষমেশ এক আসামিকে খালাস করার চুক্তি করতে এসে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটির হাতে আটক হয়ে এখন পুলিশের কব্জায় চতুর এই প্রতারক।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ওর্য়াডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের খবর প্রকাশ করার কথা বলে টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছিলেন প্রতারক কামরুল।

প্রতারককে ধরতে যেভাবে তৈরি করা হয় ফাঁদ
গার্মেন্টসকর্মী মোহাম্মদ আকাশের সঙ্গে তার স্ত্রীর বনিবনা হচ্ছিল না। পরে আকাশ ডিভোর্সের আবেদন করেন আদালতে। অল্প সময়ে ডিভোর্স করিয়ে দেওয়ার নাম করে আকাশের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় নগদ ১ লাখ টাকা নেন প্রতারক কামরুল। আদালতের ভুয়া সিলমোহর ব্যবহার করে ডিভোর্সের কাগজপত্রও দেন আকাশকে। কিন্তু পরবর্তীতে সব কাগজপত্র ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় একমাস জেল খাটতে হয় আকাশকে।

আইসিটি আইনের একটি মামলায় কক্সবাজার কারাগারে আছেন জাহেদ নামের এক তরুণ। সহজে জামিন করিয়ে দেবেন— এই কথা বলে ভুয়া ব্যারিস্টার কামরুল তার সামনে টোপ ফেলেন। নামের সামনে-পিছনে একাধিক দামি পদবি দেখে জাহেদ নামের ওই তরুণ সরল বিশ্বাসে কামরুলের হাতে তুলে দেন ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু টাকা নিয়ে আর ধরা দেন না প্রতারক কামরুল।

পরে গার্মেন্টসকর্মী আকাশ ও জাহেদ দুজন মিলে প্রতারক কামরুলকে আটকানোর পরিকল্পনা করেন। তারা এজন্য একটি ফাঁদ পাতেন। নতুন একটি মামলার জামিনের বিষয়ে দুই লাখ টাকায় চুক্তি করার জন্য প্রতারক কামরুলকে কৌশলে আনা হয় চট্টগ্রাম আদালত ভবনে।

মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) অনেকদিনের চেষ্টার পর এই প্রতারককে হাতের কাছে পেয়েই ভুক্তভোগীরা আদালত প্রাঙ্গণে পিটুনি দিয়ে তাকে নিয়ে যায় জেলা আইনজীবী সমিতিতে। সেখানে আইনজীবী নেতাদের সামনে প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে কোতোয়ালী থানায় হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় জসীম উদ্দিন নামে আরেক প্রতারককেও আটক করা হয়।

চট্টগ্রাম আদালতের শাপলা ভবন থেকে আটক করা প্রতারক কামরুলের কাছ থেকে সুপ্রিম কোর্টের লোগোযুক্ত ভিজিটিং কার্ড উদ্ধার করা হয়। সেখানে লেখা হয়, তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কর্পোরেট কনসালটেন্ট, সাউথ এশিয়ান ল’ইয়ার্স ফোরামের আন্তজার্তিকবিষয়ক সম্পাদক এবং ভূঁইয়া এন্ড এসোসিয়েটের সিনিয়র এসোসিয়েট। জব্দ করা কার্ডে লন্ডন ও ইউকে থেকে পাস করা ব্যারিস্টার হিসেবেও তিনি নিজেকে জাহির করেন। এছাড়া দ্য ব্যারিস্টার বুলেটিন ও বাংলাবাজার পত্রিকা নামে দুটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে পরিচয়পত্র পাওয়া যায় তার কাছ থেকে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এডভোকেট নাজমুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ভুয়া ব্যারিস্টার এই কামরুলের নামে আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ জমা হয়েছে। সে আইনি সহায়তার কথা বলে বিভিন্নভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আজ জেলা আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটির সদস্যরা তাকে ধরে আনে।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি ব্যারিস্টার পরিচয় দেওয়া এক প্রতারককে আটক করে। খবর পেয়ে আমরা ওই প্রতারককে আটক করে থানায় নিয়ে এসেছি।

প্রতারক কামরুলের নামে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য জেলাতেও একাধিক প্রতারণার মামলা আছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

প্রতারক আটকের ঘটনায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগেও কামরুলের বিরুদ্ধে আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছিল। তার বিরুদ্ধে ‘ভুয়া ব্যারিস্টার’ অভিযোগে ডিএমপি পুলিশ কমিশনারের কাছে ইমেইলের মাধ্যমে এজাহার পাঠিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া।

চতুর এই প্রতারকের স্থায়ী ঠিকানা খুলনা জেলায়। তবে তিনি চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরের কলসী দিঘীর পাড়ে ভাড়া বাসায় থাকেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!