ইতিহাস তার চেনা পথেই হাটলো। ছক উল্টে দিতে পারল না পাকিস্তান। বিশ্বকাপে ভারতের সঙ্গে দ্বৈরথ মানেই যেন তাদের নিশ্চিত হার। এবার নিয়ে সাতবারের লড়াইয়ে প্রতিবারই হাসিমুখ ম্যান ইন ব্লু’দের। রোববার ব্যাটে-বলে দাপট বিরাট কোহলিদের। ক্রিকেটের সেরা দ্বৈরথে মাঠের লড়াইয়ে এবারও ছিল না প্রাণ! সেই একপেশে ইতিহাস!
ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইটা ছিল একেবারেই নিস্প্রাণ। বৃষ্টির বাধায় শেষ পর্যন্ত ডাকওয়ার্থ ও লুইস ম্যাথডে ভারত জিতেছে ৮৯ রানে।
বিশ্বকাপে সাতবারের মুখোমুখিতে দ্বিতীয়বারের মতো টসে হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে ভারত দাঁড় করায় ৩৩৬ রানের বড় সংগ্রহ। পরে বৃষ্টির কারণে পাকিস্তানের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪০ ওভারে ৩০২ রানের। যার বিপরীত নির্ধারিত ৪০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ২১২ রানের বেশি করতে পারেনি পাকিস্তান। ৮৯ রানের বড় জয়ে বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত অপরাজিতই রইলো ভারত।
ম্যাচে জিততে হলে গড়তে হবে ইতিহাস, ভাঙতে হবে নানান রেকর্ড। এমন ম্যাচে শুরুটা মনঃপুত না হলেও, দ্বিতীয় উইকেটে সামলে নিয়েছিলেন ফাখর জামান ও বাবর আজম। কিন্তু হুট করেই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ। ভারতের ছুড়ে দেয়া ৩৩৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ফর্মে থাকা ওপেনার ইমাম উল হক আজ পারেননি ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতে, সাজঘরে ফিরে যান দলীয় ১৩ রানের মাথায়। তবে দ্বিতীয় উইকেটে ফাখর ও বাবর মিলে গড়েন ১০৪ রানের জুটি। দুজন মিলে রান তুলছিলেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
মনে হচ্ছিলো বেশ ভালো লড়াই হবে ম্যাচে। কিন্তু ২৪ ওভারের শেষ বল থেকে ২৭তম ওভারের শেষ বলের মধ্যেই সব সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে ভারত। এই ২৪ বলের মধ্যে মাত্র ১২ রান খরচায় ৪ পাকিস্তানিকে প্যাভিলিয়নের টিকিট ধরিয়েছেন কুলদ্বীপ যাদভ-হার্দিক পান্ডিয়ারা। যার শুরুটা হয় বাবর আজমকে দিয়ে, যিনি ছুটছিলেন ব্যক্তিগত হাফসেঞ্চুরির দিকে। কিন্তু ৪৮ রানের মাথায় কুলদ্বীপের ভেতরে ঢোকা একটি বল বুঝতে না পেরে সরাসরি বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন পাকিস্তানের তিন নম্বর ব্যাটসম্যান।
বাঁহাতি চায়নাম্যান কুলদ্বীপের পরবর্তী শিকার আরেক সেট ব্যাটসম্যান ফাখর জামান। তিনি ফুললেন্থের এক ডেলিভারিকে অবিবেচকের মতো সুইপ খেলতে গিয়ে ধরা পড়েন ফাইনলেগে দাঁড়ানো ইয়ুজভেন্দ্র চাহালের হাতে। আউট হওয়ার আগে ৭৫ বলে ৬২ রান করেন ফাখর। দুই সেট ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে বিপদে থাকা পাকিস্তান অকূল পাথারে ডুবে যায় হার্দিক পান্ডিয়ার করা ২৭তম ওভারে। সে ওভারের চতুর্থ বলে ফ্লিক করতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে দাঁড়ানো বিজয় শঙ্করের হাতে ক্যাচ দিয়ে বসেন মোহাম্মদ হাফিজ।
আউট হওয়ার আগে ৭ বলে ৯ রান করতে সক্ষম হন মিস্টার প্রফেসর খ্যাত এ অলরাউন্ডার। হাফিজ ফেরার পরের বলেই ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে সরাসরি বোল্ড হন শোয়েব মালিক। রানের খাতাই খুলতে ব্যর্থ হন তিনি। মাত্র ১২ রানের ব্যবধানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় পাকিস্তান। তবে ষষ্ঠ উইকেটে ইনিংসের হাল ধরার চেষ্টা করেন অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ ও বাঁহাতি স্পিনার ইমাদ ওয়াসিম। দুজন মিলে যোগ করেন ৩৬ রান। ইনিংসের ৩৫তম ওভারের প্রথম বলে ৩০ বলে ১২ রান করে আউট হন সরফরাজ।
এর খানিক পরই নামে বৃষ্টি। বৃষ্টির বাধায় ম্যাচ বিঘ্নিত হলে, খানিক সুবিধায় থাকে আগে ব্যাট করা দল- এটাই স্বাভাবিক। তবে উইকেট বাঁচিয়ে রেখে খেলতে পারলে পরে ব্যাট করা দলের সামনেও থাকে সমান সুযোগ। কিন্তু তা করতে পারেনি পাকিস্তান। যে কারণে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে তাদের সামনে দাঁড়িয়েছে পাহাড়সম লক্ষ্য। দ্বিতীয় দফায় বৃষ্টিতে প্রায় ৪০ মিনিট খেলা বন্ধ থাকার পর, পাকিস্তানের সামনে নতুন লক্ষ্য দাঁড়িয়েছে ৪০ ওভারে ৩০২ রানের। খেলা বন্ধ হওয়ার আগে তাদের সংগ্রহ ছিলো ৩৫ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৬৬ রান। ফলে শেষের ৩০ বলে তাদের বাকি থাকে আরও ১০২ রান। বৃষ্টি আইনের অদ্ভুত মারপ্যাচে পরে পাকিস্তান ইনিংসের ওভার কমেছে ১০টি। কিন্তু রান কমেছে মাত্র ৩৫।
এমন কঠিন সমীকরণ মেলানো সম্ভব ছিলো না দুই স্পিনিং অলরাউন্ডার শাদাব খান ও ইমাদ ওয়াসিমের পক্ষে। তবু তারা নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করে সপ্তম উইকেটে মাত্র ৩৫ বলে যোগ করেন ৪৭ রান, দলকে পার করান দুইশ রানের কোটা, ব্যবধান কমান পরাজয়ের। শেষপর্যন্ত নির্ধারিত ৪০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ২১২ রান করতে সক্ষম হয় পাকিস্তান। ইমাদ ৩৯ বলে ৪৬ ও শাদাব ১৪ বলে ২০ রানে অপরাজিত থাকেন। বৃষ্টি আইনে ৮৯ রানের বড় ব্যবধানে জয় পায় ভারত।
ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্রুততম
শচীন টেন্ডুলকারের চেয়ে ৫৪ ইনিংস কম খেলে দ্রুততম ১১ হাজার রানের মালিক এখন কোহলি। ২৭৬ ইনিংসে ১১ হাজারি ক্লাবে নাম লিখিয়েছিলেন শচীন। ১১ হাজার করতে অজি সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিং খেলেছিলেন ২৮৬ ইনিংস। ভারতের সাবেক অধিনায়ক গাঙ্গুলির লেগেছিল ২৮৮ ইনিংস।
১০০০ রান – ফখর জামান, ১৮ ইনিংস
২০০০ রান – হাশিম আমলা, ৪০ ইনিংস
৩০০০ রান – হাশিম আমলা, ৫৭ ইনিংস
৪০০০ রান – হাশিম আমলা, ৮১ ইনিংস
৫০০০ রান – হাশিম আমলা, ১০১ ম্যাচ
৬০০০ রান – হাশিম আমলা, ১২৩ ম্যাচ
৭০০০ রান – হাশিম আমলা, ১৫০ ম্যাচ
৮০০০ রান – বিরাট কোহলি, ১৭৫ ম্যাচ
৯০০০ রান – বিরাট কোহলি, ১৯৪ ম্যাচ
১০০০০ রান – বিরাট কোহলি, ২০৫ ম্যাচ
১১০০০ রান – বিরাট কোহলি, ২২২* ইনিংস
১২০০০ রান – শচীন টেন্ডুলকার, ৩০০ ইনিংস
১৩০০০ রান – শচীন টেন্ডুলকার, ৩২১ ইনিংস
১৪০০০ রান – শচীন টেন্ডুলকার, ৩৫০ ইনিংস
১৫০০০ রান – শচীন টেন্ডুলকার, ৩৭৭ ইনিংস
১৬০০০ রান – শচীন টেন্ডুলকার, ৩৯৯ ইনিংস
১৭০০০ রান – শচীন টেন্ডুলকার, ৪২৪ ইনিংস
১৮০০০ রান – শচীন টেন্ডুলকার, ৪৪০ ইনিংস
এর আগে টস জিতে ভারতকেই প্রথমে ব্যাট করার আমন্ত্রণ জানায় পাকিস্তান। ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকে কিছুটা সাবধানি ব্যাটিং করতে থাকে ভারতের দুই ওপেনার। এরপর ধীরে ধীরে হাত খুলতে থাকে তাদের। এক সময় এসে রান তোলার গতি প্রায় ৬ রানেরেটে গিয়ে পৌঁছায় ভারতের। শুরুতে মোহাম্মদ আমিরের প্রথম ওভারটা বেশ ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করলো দুই ভারতীয় ওপেনার লোকেশ রাহুল এবং রোহিত শর্মা। যে কারণে প্রথম ওভারেই মেডেন নিয়ে নিলেন আমির।
তবে পর্যবেক্ষণের পর তারা বুঝলো, এই বোলারকে একটু রয়ে-সয়েই খেলতে হবে। বাকিদের কোনো সুযোগ দেয়া যাবে না। এই পণ করেই সম্ভবত পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমেছিলেন রোহিত আর লোকেশ। সে কারণেই হয়তো শুরু থেকে পাকিস্তানের বাকি বোলারদের কোনো পাত্তাই দেননি ভারতের দুই ওপেনার। তাদের দু’জনের ব্যাটে পাকিস্তানের বিপক্ষে দারুণ সূচনা করে ভারত।
শিখর ধাওয়ান না থাকার কারণে রোহিত শর্মার সঙ্গে ভারতীয় ইনিংসের সূচনা করেন লোকেশ রাহুল। এই দুই ওপেনারই বলতে গেলে পাকিস্তানি বোলারদের নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন। ২৩.৫ ওভার টিকেছিল ওপেনিং জুটি। তাতেই স্কোরবোর্ডে রান উঠে গেছে ১৩৬।
অবশেষে ভারতীয় ওপেনিং জুটিতে ভাঙন ধরান পাকিস্তানি পেসার ওয়াহাব রিয়াজ। ২৪তম ওভারের শেষ বলে ফ্রন্ট ফুটে এসে কাভারে খেলতে যান লোকেশ রাহুল। কিন্তু যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে ব্যাটে-বলে হয়নি। কাভার অঞ্চলে দাঁড়ানো বাবর আজমের হাতে সহজ ক্যাচে পরিণত হন ৭৮ বলে ৫৭ রান করা রাহুল। ৩টি বাউন্ডারি আর ২ ছক্কায় এই রান করেন লোকেশ রাহুল।
এরপর পাকিস্তানি বোলারদের সাফল্যের খাতায় আর কোনো কিছুই যোগ হচ্ছিল না ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তায়। লোকেশ রাহুলের সঙ্গে ১৩৬ রানের জুটি গড়ার পর বিরাট কোহলির সঙ্গেও ৯৮ রানের বিশাল জুটি গড়ে ফেলেন রোহিত শর্মা। অবশেষে উইকেটের সঙ্গে সুপার গ্লু লাগিয়ে বসে যাওয়া রোহিত শর্মাকে ফেরান পাকিস্তানি পেসার হাসান আলি। ৩৯ তম ওভারে হাসান আলির বলটি শর্ট ফাইন লেগে স্কুপ করতে গিয়েই সোজা ওয়াহাব রিয়াজের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেলেন রোহিত। ততক্ষণে স্কোরবোর্ডে তার নামের পাশে খেলা হয়ে গেছে ১১৩ বলে ১৪০ রান। ১৪টি বাউন্ডারির সঙ্গে ৩টি ছক্কায় সাজানো এই ইনিংস। ২৩৪ রানের মাথায় পড়লো দ্বিতীয় উইকেট।
রোহিত আউট হয়ে যাওয়ার পর হার্দিক পান্ডিয়াকে নিয়ে জুটি গড়েন বিরাট কোহলি। দু’জনের ব্যাটে গড়ে ওঠে ৫১ রানের জুটি। এ সময় মোহাম্মদ আমিরের তোপের মুখে টিকতে পারলেন না হার্দিক। ১৯ বলে ২৬ রান করে তিনি ক্যাচ দেন বাবর আজমের হাতে। মহেন্দ্র সিং ধোনি মাঠে নেমেই ফিরে গেলেন মাত্র ১ রান করে। বৃষ্টির পর খেলা শুরু হলে বিরাট কোহলি বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। মোহাম্মদ আমিরের বলেই উইকেটের পেছনে তিনি ক্যাচ দেন সরফরাজের হাতে। ওই সময় ৬৫ বলে ৭৭ রান নিয়ে ব্যাট করছিলেন তিনি। শেষ দিকে বিজয় শঙ্কর ১৫ এবং ৯ রানে অপরাজিত ছিলেন কেদার যাদব। পাকিস্তানি বোলারদের মধ্যে মোহাম্মদ আমির ৪৭ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। হাসান আলি এবং ওয়াহাব রিয়াজ নেন ১টি করে উইকেট।