পাওনা বুঝে নিয়েই পাটকল ছাড়বে চট্টগ্রামের শ্রমিকরা

‘আগেও অবসরে যাওয়া শ্রমিকরা পেনশন পাননি। পাওনা টাকা দিতে অনীহা পাটকল পরিচালনাকারীদের। সরকারের মধ্যে থেকে সরকারি পাটকল শ্রমিকদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন আমলারা। এখন আর শ্রমিকরা এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে চান না।’

এভাবেই বললেন পাটকল ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম। তার কথায়—
‘আমরা শ্রমিকরা বারবার সরকারি নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রতারিত হয়েছি। আমাদের নিয়ে কেউ ভাবেন না। আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এখন আমরা একটিই দাবি— সেটি হল আমাদের পাওনা। পাওনা না নিয়ে আমরা পাটকল ছাড়বো না।’

বাংলাদেশে আর রাষ্ট্রমালিকাধীন কোনো পাটকল থাকছে না, সব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারিখাতে। দেশে সরকারি পাটকলগুলো পিপিপির আওতায় চলবে। পাটকল নিয়ে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। আর শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেয়া হবে অর্থাৎ বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হবে। রোববার (২৮ জুন) এক ভিডিওবার্তায় এমন সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রী।

চট্টগ্রামের আমিন জুট মিল থেকে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া আনসার আলী বলেন, ‘পাটকল শ্রমিকদের একটা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকার। চাকরি গেলে এতো মানুষ যাবে কোথায়, খাবে কী? পরিবার পরিজনের কী হবে সেদিকে কেউই ভাবছে না। আমরা যেন আমাদের পাওনা থেকে বঞ্চিত না হই।’

চট্টগ্রামে বর্তমানে সরকারি মালিকানায় মোট নয়টি পাটকল রয়েছে। সেখানে বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামের শ্রমিকদের চোখেমুখেও নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা ও হতাশার ছাপ।

চট্টগ্রামের পাটকলগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তর কাট্টলীর বাগদাদ-ঢাকা-কার্পেট ফ্যাক্টরি লি., রাঙ্গুনিয়া এলাকায় কর্ণফুলী জুট মিল, ষোলশহরের আমিন জুট মিলস লি. ও ওল্ড ফিল্ডস লি., বাড়বকুন্ড কুমিরার গুল আহমদ জুট মিলস লি., সীতাকুণ্ড বার আউলিয়া এলাকার হাফিজ জুট মিলস লি., বাঁশবাড়িয়ার এম এম জুট মিলস লি. এবং আর আর জুট মিলস লি., নাসিরাবাদের গালফ্রা হাবিব লি. (নন-জুট), এবং মিলস ফার্নিসিং লি. (নন-জুট)। এসব কারখানায় কাজ করেন অন্তত ১৫ হাজার শ্রমিক।

শ্রমিকদের অভিযোগ, বরাবরই তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছে। আমিন জুট মিলে মারা গেছে এমন শ্রমিকের পরিবারও টাকা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। চট্টগ্রামের আমিন জুটমিলের শ্রমিক নেতা কামাল হোসেন বলেন, চট্টগ্রামেও শ্রমিকদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

রোববার (২৮ জুন) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী পাটকলগুলোতে লোকসান হচ্ছে জানিয়ে বলেন, আমরা লোকসান নিয়ে পাটকল চালাতে পারি না। সরকার চিন্তা করেছে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে এই খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। পাটকল শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন।

মন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ৪০ বছর আমরা কোনো লাভ করতে পারিনি, সবসময় লোকসান হচ্ছে। সে কারণে সরকার চিন্তা করেছে কিভাবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে কারখানাগুলোকে আধুনিকায়ন করে এগিয়ে নিতে পারি। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের ক্ষতি না করে তাদের লাভবান করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

গোল্ডেন হ্যান্ডশেক হলো স্থায়ী শ্রমিককে মজুরি কমিশন অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন শ্রমিকের প্রাপ্য সকল বকেয়া, বর্তমানে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের পিএফ জমা, গ্রাচ্যুইটি এবং সেই সাথে গ্রাচ্যুইটির সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে অবসায়ন সুবিধা একসাথে শতভাগ পরিশোধ করা হবে। এজন্য সরকারি বাজেট থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে।

চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলের জিএম কামরুল আহসান খান চট্টগ্রাস প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও কোন চিঠি আসেনি। তাই আমি সঠিক করে বলতে পারছি না আসলে সরকারের চাওয়া-পাওয়া কী। তবে জুট মিলে শ্রমিকরা শান্ত আছে। এখানে কোন উত্তেজনা নেই। কারণ শ্রমিকদের দাবি ছিল একসাথে টাকা পাওয়া। এখন সরকার সেদিকেই যাচ্ছে শ্রমিকদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য।

এএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!