পাঁচলাইশের ওসি নাজিমের বিরুদ্ধে থানায় অত্যাচারের অভিযোগে মামলার আবেদন
এসআই আজিজসহ অজ্ঞাতনামা আরও পুলিশ অভিযুক্ত
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মায়ের ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের অভাবনীয় রোষের শিকার সৈয়দ মোস্তাকিমকে পুলিশি হেফাজতে নির্মমভাবে নির্যাতনের অভিযোগে পাঁচলাইশ থানার বিতর্কিত ওসি নাজিম ও এসআই আজিজসহ অজ্ঞাতনামা পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করা হয়েছে।
সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেছার আদালতে আবেদন করা হয়। এতে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন (৪২) এবং উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল আজিজ (৩৮) ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সান বলেন, পাঁচলাইশ থানা হেফাজতে সৈয়দ মোহাম্মদ মুনতাকিম প্রকাশ মোস্তাকিমকে নির্যাতনের অভিযোগে ওসি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এবং এসআই আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে হেফাজত নিবারণ আইনে মামলার আবেদন করা হয়েছে। ভুক্তভোগী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। শুনানি শেষে মামলাটি আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছেন আদালত।
অভিযোগে বলা হয়, সৈয়দ মোস্তাকিম তার মাকে গত ৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করান। সম্প্রতি ডায়ালাইসিসের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তিনিসহ রোগীর স্বজনরা মিলে আন্দোলন করেন।
গত ১০ জানুয়ারি তারা চমেক হাসপাতালের প্রধান গেটে জড়ো হয়ে মানববন্ধন করেন। পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সেখানে এসে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে ওসি নাজিম মোস্তাকিমকে গ্রেফতার করে প্রথমে একটি বেসরকারি ডায়াগণস্টিক সেন্টারের নিচে মারধর করেন। পরবর্তী থানায় তাকে মারধর ও নির্যাতন করা হয়। মারধরের সময় এসআই আবদুল আজিজ মোস্তাকিমকে বলেন ‘ওসি নাজিম স্যারের সঙ্গে আর বেয়াদবি করবি?’ এ সময় ওসি নাজিম বলেন, ‘শালারে রিমান্ডে এনে থানায় পিটাতে হবে, তারপর বুঝবি পুলিশ কী জিনিস?’ এরপর থানায় মারধরের বিষয়টি ফাঁস করলে মোস্তাকিমকে ক্রসফায়ার দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
গত ১০ ডিসেম্বর কিডনি ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে রোগীর স্বজনেরা আন্দোলন করেন। এ সময় পুলিশের সাথে আন্দোলনরতদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। গ্রেফতার মোস্তাকিমের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ৫০ থেকে ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান।
ওইদিন আন্দোলনকারী একজনকে মারতে মারতে পাশের এপিক হেলথ কেয়ারের ভেতরে নিয়ে যান পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিমসহ কয়েকজন পুলিশ। সেখানে এক নারী কিডনি রোগীকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেন ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার। ঘটনার প্রতিবাদ করায় আরেক কিডনি রোগীকে কলার ধরে মারতে থাকেন ওসিসহ কয়েক পুলিশ সদস্য। মারধরে অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই রোগীকে তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। এ ঘটনায় তুমুল নিন্দার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
থানায় পিতৃহারা যুবককে অকথ্য নির্যাতন
এর আগে জামিনে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকদের কাছে থানার ভেতরে পুলিশি নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি। বন্দিকে নির্যাতনের এমন ঘটনায় মানবাধিকারকর্মী ছাড়াও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা। তারা বলছেন, পুলিশের হেফাজতে থাকা বন্দিকে নির্যাতনের কোনো সুযোগ নেই। এটা রীতিমতো অপরাধ।
গত ১০ জানুয়ার চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রধান ফটক থেকে দুপুর ১টার দিকে আটক করার পর মোস্তাকিমকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচলাইশ থানায়। রাত ১টা পর্যন্ত তার কিডনি রোগী মা একমাত্র অবলম্বন সন্তানকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আশায় পাঁচলাইশ থানায় ছিলেন। মা থানা থেকে বের হয়ে আসার পরপরই মোস্তাকিমকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচলাইশ মডেল থানার একটি ‘টর্চার সেলে’। ওইদিন রাত দেড়টার দিকে তাকে নির্যাতন করা শুরু হয়।
মোস্তাকিম বলেন, ‘প্রথমে সাধারণ সেলে রাখা হলেও ঘণ্টাখানেক পর এক পুলিশ সদস্য এসে আলাদা একটি রুমে আমাকে নিয়ে যান। যেখানে আমি ছাড়া আরও কয়েকজন পুলিশ ছিল। প্রথমেই ওরা আমার দাড়ি দেখে জানতে চায়, আমি জামায়াত-শিবিরের লিডার কিনা? আমি বলি না। তারপর ওরা আবার বলে, তাহলে দাড়ি এত বড় কেন? এটা তো শিবিরের দাড়ি। তখন আমি বলি, আমাকে কিছু এনে দেন; আমি দাড়িটা কেটে ফেলি। এটা বলার পরপরই একটি কালো লাঠি দিয়ে আমাকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারতে থাকে। ওরা এমনভাবে মারছিল যে, কোথায় আঘাত লাগছে সেটাও দেখছিল না।’
জানা গেছে, মোস্তাকিম ‘জামায়াত-শিবিরবিরোধী’ হিসেবে পরিচিত ইসলামী ছাত্রসেনার চট্টগ্রাম নগরের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড শাখার আহ্বায়ক। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউসিয়া কমিটির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।
মোস্তাকিম বলেন, লাঠির মারে কোমরের নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লাঠির আঘাতে লাল হয়ে যায়। উরু ও পায়ে মারার পর যখন আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না, এরপর হাত দিয়ে আমার উরু বাঁচাতে যাই; তখন হাতে মারা শুরু করে।
পেটানোর সময় এক পুলিশ বারবার বলছিল, ‘ওসি স্যারের সঙ্গে আর বেয়াদবি করবি?’
মোস্তাকিম বলেন, ‘তারা এতটাই অমানবিক যে, আমার পুরুষাঙ্গেও আঘাত করে। যখন আমি অনেকটা অজ্ঞানের মতো হয়ে যাই, তখন আমাকে আবার আগের সেলে নিয়ে যায়। পুরুষাঙ্গের ব্যথায় আমি দু’দিন প্রস্রাব করতে পারিনি। রক্তও যায় পুরুষাঙ্গ দিয়ে।’
মোস্তাকিম বলেন, যখন যন্ত্রণায় ফ্লোরে শুয়ে মুক্তির ক্ষণ গুনছি, তখন এক পুলিশ এসে বলে—‘রেস্ট নে, তোরে রাতে আবার সাইজ করবো।’
তিনি বলেন, ‘শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি পুলিশের এমন মানসিক যন্ত্রণা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না। যদিও সেদিন রাতে আর মারেনি আমাকে।’
মোস্তাকিম বলেন, ‘সারাদিন নির্যাতনের পর আমি রাতে অসুস্থবোধ করি। তখন আমাকে একটি গাড়িতে করে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যায়। ডাক্তার দেখানোর পর আমাকে রুমের বাইরে নিয়ে আসে। একজন পুলিশ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ওষুধ নিয়ে চলে আসে। আমাকে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো কথা বলতে দেয়নি। থানায় নিয়ে আসার পর যখন প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছি, তখনও আমাকে কোনো ওষুধ খেতে দেয়নি ওরা। হয়ত মরে যাবো কি-না সেই ভয়েই হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’
জামিন পাওয়ার পর মোবাইল আনতে মা-বোনসহ পাঁচলাইশ থানায় যান মোস্তাকিম। ওই সময় ওসি যথেষ্ট আপ্যায়ন এবং ভালো নাস্তা খেতে দেন বলে জানান মোস্তাকিম।
মোস্তাকিম বলেন, ‘নাস্তা খাওয়ার পর দেখি, কোন একটা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে আসছে। জিজ্ঞেস করছে আমাদের কেউ নির্যাতন করেছে কি-না। এর আগে ওসি এবং ক্যামেরাম্যান আমাদের বলে দিয়েছে, ‘বলবা কেউ মারেনি’। তাই আমরা বাধ্য হয়ে ওসির শেখানো কথামতো মিথ্যা জবানবন্দি দিই।’
কেন মিথ্যা বলতে গেলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাকিমের মা বলেন, ‘কী করব বাবা? ওরা ৭-৮ জন পুলিশ আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন থানা থেকে বের হওয়াটাই ফরজ হয়ে দাঁড়াইছে আমাদের জন্য। যদি ওদের কথা মতো না বলি, তখন যদি আবার আমার ছেলেকে মারে? সেই ভয়ে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছি।’
ওসি নাজিমের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ
গত ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেলে কিডনি ডায়ালাইসিসে বর্ধিত ফি প্রত্যাহার না করায় বিক্ষোভকারী একজনকে মারতে মারতে পাশের এপিক হেলথের ভেতরে নিয়ে যান পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিমসহ কয়েকজন পুলিশ। সেখানে এক নারী কিডনি রোগীকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেন ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার। ঘটনার প্রতিবাদ করায় আরেক কিডনি রোগীকে কলার ধরে মারতে থাকেন ওসিসহ কয়েক পুলিশ সদস্য। মারধরে অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই রোগীকে তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বিতর্কিত নানা ঘটনায় সমালোচিত চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ মডেল থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার এর আগে আরও এক অস্বাভাবিক এক ঘটনার জন্ম দিয়ে আলোচনায় আসেন। এক মামলাতে এজাহারই জমা নেয়নি পাঁচলাইশ থানা। অথচ এজাহার ছাড়া মামলা দায়েরের সুযোগই নেই। এমন অস্বাভাবিক ঘটনায় শেষপর্যন্ত আদালতের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ওসি নাজিম।
তারও আগে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জমিতে বালু ভরাটে ভূমিদস্যু চক্রকে সহযোগিতার অভিযোগ উঠে খোদ পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার ও এসআই মো. ইলিয়াছের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় গত ১৮ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বরাবরে ওসি-এসআইসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় দিনরাত মাদক থেকে জুয়া, ছিনতাই থেকে যৌনবাণিজ্যে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। স্থানীয়রা জানান, পুলিশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা রেলস্টেশনে সুযোগ বুঝে ছিনতাইয়েও জড়িয়ে পড়ছে।
আরএম/সিপি