কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপকে ঘিরে মিঠাপানি সরবরাহের বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। আগামী ৩০ বছরে ৬ ধাপে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানিতে তৈরি হওয়া সংকট দূর করে বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে এমন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
এই প্রকল্পের আওতায় দ্বীপ দুটির ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উখিয়ার হোয়াইক্যং পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে মিঠা পানি যাবে দ্বীপ দুটিতে। এর ফলে সেন্টমার্টিনের পাশের এই দ্বীপ এলাকা দুটিতে অত্যাধুনিক ট্যুরিজম প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে করছে বেজা।
কক্সবাজার থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে টেকনাফের সাবরাংয়ে এক হাজার ৪১ কিলোমিটার জমিতে গড়ে উঠছে নতুন এক পর্যটন অঞ্চল। থাইল্যান্ডের পাতায়ার আদলে সাবরাংকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন অঞ্চলে রূপ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, সাবরাং হবে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পর্যটন অঞ্চল। বিনিয়োগ হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সেখানে থাকবে পরিবেশবান্ধব শহর, সুন্দরবনের থিম পার্ক ও নাইট সাফারি, রয়্যাল ক্যাসিনো, গলফ ক্লাব, অ্যাকোয়ারিয়াম, জাদুঘর, হেরিটেজ পার্ক, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, ক্লাবসহ অন্যান্য সুবিধা। এছাড়া থাকছে ১০০ শয্যার হাসপাতাল এবং স্কুল।
অন্যদিকে নাফ নদীর জালিয়ার দ্বীপটিকে ঘিরে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম বিশেষায়িত ট্যুরিজম পার্ক। ২৯১ একর ভূমির এই দ্বীপকে আন্তর্জাতিকমানের ট্যুরিজম পার্কে রূপ দেওয়ার কাজ চলছে। এই ট্যুরিজম পার্কে পাঁচ তারকা হোটেল, ঝুলন্ত সেতু, ৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার ক্যাবল কার নেটওয়ার্ক, রিসোর্ট, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, ওশানেরিয়াম, ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ বিনোদনের বিভিন্ন আয়োজন রাখার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘লবণাক্ততা পুরো কক্সবাজার এলাকার জন্যই একটা বড় সমস্যা। টেকনাফ-উখিয়ার ওই দিকটায় মানুষ মিঠা পানির দেখা পায় না। আমাদের পরিকল্পনায় থাকা দুটি অত্যাধুনিক ট্যুরিজম এলাকা নির্মাণের ক্ষেত্রে পানির লবণাক্ততা ছিল একটা বড় বাধা। এখন আমরা সেই বাধা দূর করার একটা উপায় বের করতে পেরেছি।’
‘সাবরাং অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপন ও জালিয়ার দ্বীপে নাফ ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণে মিঠা পানির সংকট সবচেয়ে বেশি চিন্তায় ফেলেছিল অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) গত এক বছর ধরে মিঠা পানির বিভিন্ন উৎস খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এক বছর গবেষণার পর দ্বীপ দুটি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে হোয়াইক্যংয়ে এই মিঠা পানির উৎসের সন্ধান পেল আইডব্লিএম। সেখান থেকে পাইপে করে পানি সরবরাহ করতে একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে বেজা।
বেজার নিজস্ব উদ্যোগে নেওয়া এই পরিকল্পনা অনুসারে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ছয়টি ধাপে বাস্তবায়ন হবে এই প্রকল্প। সব মিলিয়ে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। প্রথম ধাপের কাজ হবে ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এতে খরচ হবে ১৪৪ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপে খরচ হবে আরও ৮ কোটি টাকা।
পানি সমস্যা দূর করতে একটি বিশদ প্রকল্প প্রস্তাবনাও এর মধ্যে বেজাকে দিয়েছে আইডব্লিউএম। আইডব্লিউএমের প্রতিবেদনে বলা হয়, উখিয়ার হোয়াইক্যংয়ে মোট আটটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে। থাকবে আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে থাকবে পৃথক ব্যবস্থা। শিল্পের পানি রিসাইক্লিং করে তা পুনরায় ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি লবণাক্ততা দূর করে পানি ব্যবহারের উপযোগী করার প্রচেষ্টাও থাকবে।
এতে দেখানো হয়, হোয়াইক্যংয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১৫ লিটার ক্ষমতা সম্পন্ন মোট আটটি গভীর নলকূপ বসানো হবে। ওয়াটার ফিল্ড থেকে ৫০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে সাবরাংয়ে ১৩ কিলোমিটার এবং নাফ ট্যুরিজম পার্কে ১০ কিলোমিটার বিতরণ লাইন যোগ হবে। এছাড়া সাবরংয়ে তিনটি এবং নাফ ট্যুরিজম পার্কে দুটি আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার থাকবে। এসব রিজার্ভারে বসানো হবে মোট ছয়টি শক্তিশালী পাম্প। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে কাজে লাগানোর জন্য দুটি পার্কে করা হবে মোট ১৮০টি সংরক্ষণাগার।
এছাড়া দুটি পৃথক স্থানে লবণাক্ত পানি শোধন করে মিঠা পানিতে পরিণত করার দুটি সীমিত ব্যবস্থাপনাও থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ছয়টি ধাপে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা খরচ হবে।
২০২৪ সালে প্রকল্পের প্রথম ধাপ, ২০২৯ সালে দ্বিতীয় ধাপ, ২০৩৪ সালে তৃতীয় ধাপ, ২০৩৯ সালে চতুর্থ ধাপ, ২০৪৪ সালে পঞ্চম ধাপ এবং ২০৪৯ সালের মধ্যে সর্বশেষ ধাপ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
এআরটি/সিপি