পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশ, ‘আইলার’ গতিতে ধেয়ে আসছে বুলবুল
চট্টগ্রামে ৬ নম্বর মহাবিপদ সংকেত
আবার পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হেনেছিল অতি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আইলা। শনিবার সন্ধ্যা কিংবা মধ্যরাতে আবারও তেমনই একটি অতি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের গতি থাকবে আয়লার মতোই, ঘণ্টায় ১২৫ কিলোমিটার!
ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ প্রবল থেকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে ইতিমধ্যে। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকা থেকে এটি ৪৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এ কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে ৬ নম্বর এবং পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ঘণ্টায় ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, শনিবার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে এ ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় চট্টগ্রাম বন্দরে জরুরি সভা করা হয়েছে। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) বিকেল ৫টায় জরুরি সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাস বন্ধ রেখে পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় ৬ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বিকেলে জরুরি সভার ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষ।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে ১৭টি জাহাজ অবস্থান করছে এবং এসব জাহাজে মালামাল ওঠানামা করছে। কিন্তু বন্দর বহির্নোঙ্গরে অবস্থান করছে পণ্যবাহী ৫৫টি জাহাজ। এসব জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে ৬ নম্বর সংকেত জারির পর চট্টগ্রাম সুমুদ্র বন্দরে লাইটারেজ কোনো জাহাজ কর্ণফুলী নদী থেকে বঙ্গোপসাগরে বর্হিনোঙ্গরে যাচ্ছে না। ঝুঁকি এড়াতে বন্দরের জেটি থেকে সব জাহাজ বহির্নোঙ্গরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। জেটিতে ক্রেনসহ কন্টেইনার ও পণ্য ওঠানামায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম সুরক্ষার আদেশ দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
নৌ-বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিমান ওঠানামা স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান বন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার এবিএম সারওয়ার-ই-জাহান। সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন। এছাড়া জেলা সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
জাহাজগুলোকে জেটি ছাড়তে বলা হয়েছে। জেটিতে বন্দরের যেসব ইকুইপমেন্ট আছে সেগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সুরক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বন্দরের জেটিতে ও জেটি সংলগ্ন ইয়ার্ডে কন্টেইনার থেকে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ে যেসব ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, কন্টেইনার মুভার ইতোমধ্যে ঢুকে গেছে সেগুলোকেও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে।
সচিব বলেন, যেসব ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্দরে ঢুকে গেছে, তাদের কাজ আমরা বন্ধ করিনি। তাদের সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বলেছি। যদি ঘূর্ণিঝড় আরও তীব্র হয়, তখন তাদের কাজও বন্ধ করে দেয়া হবে। তবে নতুন করে কোনো ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্দরে এই মুহূর্তে না ঢোকানোর সিদ্ধান্ত আছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলের’ কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ বিভাগের সকল জেলা এবং উপজেলায় সভা আহ্বান করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সহ সকল জেলা ও উপজেলায় কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা থেকে সরে সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন প্রশাসন। শুক্রবার সকাল থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ মেঘলা রয়েছে।
সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ডে বঙ্গোপসাগরের উপকূল রয়েছে।এসব উপকূল থেকে সাধারণ মানুষ সরে নেওয়ার জন্য ৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভয়াবহ এই ‘বুলবুল’ মোকাবেলার জন্য পুর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের গাড়ি শ্রমিক সেবক সবাইকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নগরের রাস্তাঘাট পরিষ্কারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সব জেলা উপজেলায় জরুরি সভা করে সার্বিক প্রস্তুতির জন্য বলা হয়েছে।
প্রস্তুত রয়েছে রেড ক্রিসেন্টর স্বেচ্ছাসেবী দল।এছাড়া ফায়ার সার্ভিস পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন জরুরি সভা করে পুর্ববর্তী ও পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ উপকূলের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ায় শুক্রবার বিকেল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরকে ৬ (ছয়) নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
মহানগরসহ সকল উপজেলার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রয়েছে। সবাইকে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ সম্পর্কে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।
সাগর উত্তাল থাকায় লাইটারেজ জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার-ছোট জাহাজ, সাধারণ নৌকাসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলের যুগ্ম-পরিচালক হাজী শফিক আহমেদ জানান, বন্দরের বহির্নোঙ্গরে কোনো লাইটারেজ জাহাজ যাচ্ছে না। বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য ওঠানামা বন্ধ আছে। কর্ণফুলী নদীতে এবং বিভিন্ন ঘাটে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত একশরও বেশি লাইটারেজ জাহাজ অবস্থান করছে।
এছাড়া কর্ণফুলী নদীতে মাছ ধরার নৌযানগুলোকে তীরে এনে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। প্রায় ২০০ মাছ ধরার নৌযান এখন কর্ণফুলী নদীতে অবস্থান করছে।
এদিকে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জানিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। সম্ভাব্য মোকাবিলার জন্য সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আশ্রয় কেন্দ্র, শুকনো খাবার ও স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকা ও পাহাড়ে বসবাসকারী লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় জন্য পর্যাপ্ত খাবার মজুদ রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক। প্রতিটি উপজেলায় আলাদা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও সম্ভাব্য উপদ্রুত এলাকার মানুষের জন্য শুকনো খাবারও মজুদ রাখতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, উপকূলীয় উপজেলাগুলোর মধ্যে সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই ও আনোয়ারায় মাইকিং চলছে। লোকজনকে সাইক্লোন সেন্টারে চলে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। ক্ষেতে পাকা ধান থাকলে সেগুলো কেটে ফেলার জন্য চাষীদের বলা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে ২৮৪টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ উপজেলায় ৫টি করে ৭০টি, ২০০ ইউনিয়নে ১টি করে মোট ২০০টি, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৫টি এবং নগরে আরও ৯টি আরবান ডিসপেনসারি টিম গঠন করে তাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
প্রতিটি টিমে ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট মিলিয়ে তিনজন করে সদস্য রাখা হয়েছে। মোট ৮৫২ জন টিমের সদস্যকে সম্ভাব্য দুর্যোগসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া, ৯ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ওষুধ এবং সাড়ে ৪ লাখ ওরস্যালাইনও মজুদ আছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।
এএস/এসএস