পরিবেশের ‘অপমৃত্যু’ এবং পরিচালকের ঘরের পরিবেশ
পৃথিবীর বিখ্যাত ব্রাজিলের আমাজন বনের গাছ-গাছালি আর লতাগুল্মের গভীরতা এতই বেশি যে বলা হয়ে থাকে, ‘আমাজনের গহীনে গাছের পাতা ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছাতে পারে না।’ সূর্য উদিত হোক আর না হোক, বনের পরিবেশ থাকে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন।’ আমাজনের সেই পরিবেশের সাথে চট্টগ্রাম মহানগরীর কিছু কিছু এলাকার পরিবেশেরও দারুণ মিল দেখা যায়। এখানেও সূর্য উঠুক আর না উঠুক, চৈত্রের ফকফকা রোদের দিনেও পরিবেশ থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন, কনকনে শীতের ভোরের মতো কুয়াশার চাদরে ঢাকা। তবে এখানকার কারণটি ভিন্ন। আমাজনের গাছের ডাল-পাতা-লতাগুল্ম সেখানে সূর্যের আলোকে মাটিতে পৌঁছাতে বাধা দেয় দেয়, আর চট্টগ্রামে আগ্রাসী কিছু মানুষের স্থাপিত কলকারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ভেদ করে সূর্যের আলো সমতলে ঘেঁষতে পারে না। আমাজনের গাছের পাতা সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে প্রকৃতিকে সুরক্ষা দেয়, চট্টগ্রামের বিষাক্ত ধোঁয়ার সাথে সূর্যের রশ্মি মিলে তা আরও মারাত্মক বিধ্বংসী হয়ে প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে, বাতাসের বস্তুকণায় মিশে পুরো অঞ্চলের মানুষ ও প্রাণীদেহে তা ঢুকে পড়ছে।
নগরীর বায়েজিদ এলাকায় আপনি যে সময়েই যাবেন, দেখবেন বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আকাশ, দিনদুপুরে সেখানে নেমেছে রাতের অন্ধকার। রড উৎপাদনকারী মূলধারার প্রতিষ্ঠানের বাইরে এখানে গড়ে উঠেছে কিছু ‘অবৈধ কারখানা।’ এই কারখানাগুলো থেকে দিনরাত সব সময় বিষাক্ত কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। পরিবেশ দূষণরোধ করার কোনো ব্যবস্থা তারা রাখেনি, কারখানায় নেই কোনো বর্জ্য শোধনাগার, ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা ইটিপি। পুরো বায়েজিদ এলাকা তাদের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকে সব সময়। তাদের এই পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকা- চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই লেখালেখি হয়, পরিবেশবাদীদের বক্তৃতা-বিবৃতি চলে কিন্তু মালিকদের তাতে ‘কিছু যায় আসে না।’
একই পরিস্থিতি কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়জুড়ে— দক্ষিণ পাড়ে এবং মইজ্যার টেক এলাকায়। কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ের সদরঘাট এলাকায় ভোরে গেলে দেখা যায় দক্ষিণ পাড়ের আকাশ কলকারখানার কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে যে তথ্যটি জানা গেছে, তা হলো কারখানার মালিকরা ইটিপি খরচ বাঁচাতে, ভোর রাতের দিকে কারখানা পরিশোধন করতে কালো ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। এখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিও চলছে দীর্ঘদিন ধরেই।
শুধু বায়ু দূষণই শেষ কথা নয়; নদীর পানি, চাষের জমি থেকে সবকিছুই নানাভাবে ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। পাহাড়-নদী-সমুদ্র ঘেঁষা অপরূপ সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি চট্টগ্রামের প্রকৃতির ওপর মানুষের অবিবেচক কর্মকাণ্ডের চাপ বাড়তেই আছে। মানুষ বাণিজ্যিক স্বার্থে, কোনো অনৈতিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অনেকটা ‘জিম্মি করে’ পরিবেশের গলাটিপেই চলছে। এসব পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলাফল যে ধীরে ধীরে কী মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে, তা কল্পনা করাও কঠিন। প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচার যতই বাড়তে থাকে, প্রকৃতি ততই হিংস্র হতে থাকে। এক সময়ে সেই হিংস্র প্রকৃতির রোষানলের শিকার হয় মানবজাতিই। হাতেগোনা কিছু অবিবেচক মানুষের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রকৃতির প্রতিশোধের কবলে পড়ে পুরো অঞ্চলের সব মানুষ।
এসবের প্রতিকার কোথায় কিসে কিভাবে— সে আলোচনার শেষ সীমানা পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোথায় কী গলদ। প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা, পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা কিংবা প্রকৃতির ওপর মানুষের যেসব অত্যাচার চলে সেসব থেকে আগ্রাসী মানুষজনকে বিরত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে যাদের কাঁধে— সে প্রতিষ্ঠানটি হলো পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ ঠিক রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত সেই অধিদপ্তরের কর্তা, চট্টগ্রামের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক গত সপ্তাহে নিজের বাসায় চুলার আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন, তার হাত ও মুখের কিছু অংশ পুড়ে গেছে বলে পত্রিকাগুলো খবর দিয়েছে। চট্টগ্রামের পরিবেশ নিরাপদ-দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব যাদের কাঁধে তাদের বাড়ির রান্নাঘরের পরিবেশই যদি এতটা অনিরাপদ হয়, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে অনুমান করতে কষ্ট হয় না বা বলতে দ্বিধা হয় না যে, চট্টগ্রামের পরিবেশ এই অধিদপ্তরের কাছে কতটা ‘অনিরাপদ।’
যে অধিদপ্তরের কর্তা ব্যক্তিদের রান্নাঘরের পরিবেশই নিরাপদ নয়, সে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম (অর্থাৎ পরিবেশ সুরক্ষা, নিরাপদ রাখা) নিয়ে প্রতীকী অর্থে হলেও প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। পরিবেশ সচেতন মানুষের ভাষায়, এই অধিদপ্তরের ‘অদক্ষতা, অযোগ্যতায়’ কিংবা অধিদপ্তরের ভাষায় ‘জনবল সংকট-আইনি দুর্বলতাসহ’ নানা কারণে এই অঞ্চলের পরিবেশ যে দিন দিন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে তার স্বীকারোক্তি এ প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানেই মেলে।
একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র পরিসংখ্যান দিয়েছে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধুলোর পরিমাণ ১৫০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয়। কিন্তু ২০১৭ সালে নগরীর বাতাসে তার পরিমাণ মিলে ২৩২ মাইক্রোগ্রাম। পরের বছর ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৩ মাইক্রোগ্রামে এবং সর্বশেষ গত বছর বা ২০১৯ সালে মিলেছিল ৩৩০ মাইক্রোগ্রামে। বাসাতে প্রতি ঘনমিটারে প্রলম্বিত বস্তুকর্ণা ২০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় মাত্র। কিন্তু নগরে মিলেছে তার চারগুণ, অর্থাৎ ৮০০ মাইক্রোগ্রাম! পরিসংখ্যানই বলছে দিন দিন পরিস্থিতির কী ভয়াবহ অবনতি ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় কী ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব।
নগরীর যেসব এলাকায় পরিবেশ দূষণের কথা উল্লেখ করেছি, সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর নামে এ প্রতিষ্ঠানটি কি ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তাও বলা উচিত। প্রতিষ্ঠানটি নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে কখনো পরিবেশ সুরক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে এমনটি শোনা যায় না, কেবল পত্র-পত্রিকায় কোনো এলাকার পরিবেশ দূষণ নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে, অনেকটা যেন বাধ্য হয়ে দায়ীদের ‘শুনানিতে’ ডাকেন। শুনানি করে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু টাকা জরিমানা করেন, সেটা আবার পত্রিকায় খবর দিয়ে যাদের জানিয়ে দেওয়া দরকার (অর্থাৎ শুধুমাত্র, প্রতিবেদনকারী সাংবাদিকদেরই জানানো উচিত কি-না) তাদের জানিয়ে দেন। ব্যাস! এই গেল তাদের কাজ।
আর দানবীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ‘বিনাবাক্যে’ সে টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের কাজ চালাতে থাকে। একটি কারখানা পরিবেশ সম্মতভাবে চালাতে, ইটিপি চালু রেখে উৎপাদন করতে গেলে তাদের মাসে যে পরিমাণ খরচ যাওয়ার কথা, তা না করে একই পণ্য উৎপাদন করে তারা যে পরিমাণ বাণিজ্য করে, সেই হিসেবে তাদের কাছে জরিমানার টাকার ‘খুবই নগণ্য, সিকি পরিমাণ মাত্র’। সুতরাং যার কাজ যে করতেই থাকুক, পরিবেশ-প্রতিবেশ গোল্লায় যাক। মানুষ অসুস্থ হলে তাতে কার কী আসে যায়? তাদের তো আর চিকিৎসার খরচ কারখানারগুলোর মালিকদের বহন করতে হচ্ছে না। আমজনতার চিকিৎসার ভার নিজেদের পকেট থেকেই যাবে। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, এভাবে চলতে চলতেই, এতদিনে প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশের এক প্রকারের ‘অপমৃত্যু’ তো ঘটেই গেছে, সেই মৃত পরিবেশ এখন মানুষজনকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে; যা স্বাভাবিক নয়— পরিবেশের মতোই ‘অপমৃত্যু।’
আবু মোশাররফ রাসেল : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ