পবিত্র সিজদাহ মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ মাধ্যম

সিজদাহ একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ নত হওয়া, বিনয় প্রকাশ করা, আনুগত্য স্বীকার করা, আত্মসমর্পণ করা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুসলিমদের প্রার্থনাপদ্ধতি তথা সালাতের অন্যতম এবং আবশ্যকীয় একটি অংশ। ইবাদতের জন্য কপাল ও নাককে মাটিতে রাখা কাকুতি মিনতি সহকারে মাথা নত করা। বস্তুত সিজদাহ এমন এক অনন্য অদ্বিতীয় ও অনির্বচনীয় সম্মাননা যা শুধু আল্লাহতায়ালারই প্রাপ্য। সিজদাহ আল্লাহতায়ালার নৈকট্য প্রাপ্তির সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। তাঁকে পাওয়ার তাঁর মুহাব্বত এবং ভালোবাসা লাভের শ্রেষ্ঠতম উপকরণ সিজদাহ। সিজদাহ মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাধিক পছন্দনীয় আমল। কিয়ামতের দিন উম্মতে মুহাম্মদির বিশেষ নিদর্শন হবে অজু এবং সিজদার চিহ্ন। মহান আল্লাহ বলেন তুমি সিজদাহ করো আর আমার নিকটবর্তী হও। সেজদা আল্লাহর অত্যন্ত পছন্দের ইবাদত। কারণ এর মাধ্যমেই আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে। এ কারণেই নামাজের প্রতি রাকাতের চূড়ান্ত ধাপে সিজদার বিধান রাখা হয়েছে। সেজদা নামাজে যেমন আছে তেমনি নামাজের বাইরেও সেজদা একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। সেজদায় গিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে আল্লাহ সেই দোয়া কবুল করেন। মহানবী (সা.) বলেন বান্দা যখন সেজদায় থাকে তখন সে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হয়। অতএব তখন বেশি বেশি দোয়া করতে থাকো শুধু মানুষই নয় সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টিই সেজদা দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে।

নামাজের বাইরে যখনই আনন্দদায়ক কিছু ঘটতো বা স্রষ্টার পক্ষ থেকে কুরআন শরীফে সেজদা করার কথা বলা হতো তখন রাসূল (সা.) কৃতজ্ঞতার সেজদা দিতেন। রাসূল (সা.) এর জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আল্লাহকে ভয় পেয়ে নয় বরং তাকে ভালবেসে ও তার অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তে সেজদা করা। পূর্ববর্তী নবী-রাসূল (সা.) গণ যেখানে ভয় ও অনুশোচনার মাধ্যমে স্রষ্টাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন সেখানে বিশ্বজাহানের প্রতি রহমতস্বরূপ প্রেরিত হযরত মুহাম্মদ (সা.) শোকরিয়া ও স্রষ্টার করুণাময় রূপ উপলব্ধি করার মাধ্যমে মহাপ্রভূকে পাবার স্বর্ণপথের সন্ধান দিয়েছেন।

হযরত আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত সূরা সাদ তেলাওয়াত করার সময় রাসূল (সা.) সেজদা করলেন এবং বললেন দাউদ অনুশোচনার সেজদা করতেন। আর আমি সেজদা করি কৃতজ্ঞতার। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) রাতে নামাজ পড়তে পড়তে তাঁর পা ফুলে যেত। আমি হযরতকে (সা.) বললাম হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি কেন এমন করেন আপনার আগের ও পরের সমস্ত গুণাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.) জবাব দিলেন আমি কি তার কৃতজ্ঞ বান্দা হব না ? রাসূল (সা.) এর কাছে যখন এমন কোন সংবাদ আসত যা তাকে আনন্দিত করত বা এমন পরিস্থিতি দেখা দিত যেখানে তিনি আনন্দিত হতেন তখন তিনি মহান বরকতময় আল্লাহর শোকরিয়া আদায়স্বরূপ সিজদায় পড়ে যেতেন।

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে কেবল তারাই আমার নিদর্শনগুলো বিশ্বাস করে যাদের তা স্মরণ করিয়ে দিলে তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা কীর্তন করে এবং অহংকার করে না। একটা সিজদাহর কত দাম। সঠিকভাবে সিজদা দিতে না পারার ব্যথা কতটা কষ্টদায়ক তা একমাত্র বৃদ্ধরা বলতে পারবেন। আজকে আমরা কতশত সিজদাহ মিস করছি। একটিবার চিন্তা করে দেখুন ইবলিশ মাত্র একটি সিজদা না দেওয়ায় পরিণতি কত ভয়াবহ হয়েছে। ইবলিশ বড় আবেদ ছিল। সাতটি আসমানে তাকে সাত নামে ডাকা হতো। ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিল। কিন্তু শুধু একটি সিজদাহ দিতে অস্বীকার করায় আজকে তার পরিণতি কত ভয়াবহ। একটা সিজদা দিতে অস্বীকার করায় আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়েছে। পৃথিবীতে যা কিছু আল্লাহতাআলা সৃষ্টি করেছেন সবাই আল্লাহকে সিজদা করে। পবিত্র কোরআনে সে কথায় বিধৃত হয়েছে আর আসমানসমূহ ও জমিনের সবকিছুই আল্লাহর জন্য অনুগত্য ও বাধ্য হয়ে সকাল-সন্ধ্যায় সিজদা করে এবং তাদের ছায়াগুলোও : আর আসমান ও জমিনের যত প্রাণী এবং ফেরেশতা আছে সবাই আল্লাহকেই সিজদা করে তারা অহংকার করে না। তারা তাদের উপরস্থ রবকে ভয় করে এবং তাদেরকে যা নির্দেশ দেওয়া হয় তারা তা পালন করে।

পবিত্র সিজদাহ করার বড় ফযীলত ও মাহাত্ম রয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত পাঠ করে সিজদাহ করে তখন শয়তান দূরে সরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে হায় ধ্বংস আমার ও সিজদাহ করতে আদেশ পেয়ে সিজদাহ করে ফলে ওর জন্য রয়েছে জান্নাত। আর আমি সিজদার আদেশ পেয়ে তা অমান্য করেছি ফলে আমার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। রুকু এবং সিজদায় করা দোয়াগুলির পিছনে কি কোনো নির্দিষ্ট কারণ আছে। আমরা রুকুতে বলি-সুবহানা রব্বিয়াল আযীম অর্থ : আল্লাহ আপনি কতই না পবিত্র এবং আপনি সবচেয়ে শক্তিধর। আমরা সিজদায় বলি-সুবহানা রাব্বিয়াল আলা অর্থ : আল্লাহ আপনি কতই না পবিত্র এবং আপনার মাকাম সবচেয়ে উঁচু। তারপর রুকু থেকে উঠতে উঠতে আমরা বলি–-সামি আল্লাহু লিমান হামিদা অথর্ : আল্লাহ সেই ব্যক্তির কথা শোনেন যে তার প্রশংসা করে। তারপর পরই দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ অথর্ : হে আল্লাহ! যাবতীয় প্রশংসা কেবল তোমারই। যেন আমাদের কথাগুলো যে আল্লাহ সুবহানাতাআলা শুনবেন সেটা নিশ্চিত করে রাখলাম। ঠিক সিজদায় যাবার আগে কেন এটা নিশ্চিন্ত করে নিলাম যে আল্লাহ আমার সব কথা শুনবেন ? কারণ সিজদায় বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে কাছে চলে যায় এবং সিজদা হচ্ছে দুয়া কবুলের মোক্ষম সময়।

রাসুল (সা.) বলেছেন সিজদারত বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী। সুতরাং সে সময় তোমরা বেশি বেশি দুয়া করো। তাই আল্লাহর সাথে বান্দার এই মহামিলনের ঠিক আগ মুহূর্তে-সামি আল্লাহু লিমান হামিদা রিমাইন্ডার দিচ্ছে যে আল্লাহর কাছে যা চাওয়ার সিজদায় গিয়ে উজাড় করে চেয়ে নাও। তিনি তোমার সব আকুতি-মিনতি শুনছেন। একটাও মাটিতে পড়বে না। প্রতিটি দোয়া রাব্বুল আলামিনের দরবারে মেহমান হয়ে পৌঁছাবে। সাহাবিরা সিজদার সময় মৃত্যু কামনা করতেন। রাসুল (সা.) বলেছেন কেউ যদি অনেক বছর ইবাদত করে সিজদায় মৃত্যুবরণ করেন। তাহলে তাঁর মতো সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই। সিজদা হলো মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার সবচেয়ে উত্তম পন্থা। শেখ আবদুল হামিদ কিসক (রহ.) বলতেন হে আল্লাহ দুনিয়ায় আমাকে ইমাম হিসেবে রেখো ইমানের সঙ্গেই চলার তৌফিক দাও এবং শেষ বিচারের দিনে আমাকে সিজদারত অবস্থায় উত্তোলিত করো। কারণ রাসুল বলেছেন তোমরা মৃত্যুর আগে শেষ যে কাজ করবে সেই অবস্থাতেই তোমাদের উত্তোলিত করা হবে।

সিজদার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন কোনো বান্দা যখন আল্লাহর উদ্দেশে সিজদাহ করে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করেন এবং নেকি দান করেন ও তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। সিজদারত অবস্থায় বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সুতরাং তোমরা সিজদায় বেশি বেশি দোয়া পড়। কিয়ামতের দিন রাসূল (সা.) ঈমানদারদেরকে চিনবেন তাদের সিজদার স্থান ও তাদের অজুর অঙ্গগুলোর ঔজ্জ্বল্য দেখে। সিজদাহ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। সিজদাহ জান্নাত লাভের কারণ। সিজদাহ দোয়া কবুল হওয়ার মাধ্যম। একটি সিজদাহ দুনিয়া ও দুনিয়ার ভেতর যা কিছু আছে তার চেয়েও উত্তম। এ জন্য রাসূল (সা.) সিজদাতে খুব বেশি দোয়া পড়তেন এবং এত বেশি দেরি করতেন যে পেছনে মুক্তাদি সাহাবিরা মনে করতেন যে রাসূল (সা.) মনে হয় দ্বিতীয় সিজদার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। সিজদাহ মুক্তির মহাসোপান। সিজদার সম্মান শুধু দুনিয়ায় নয় আখিরাতেও অনেক বেশি। রাসুল (সা.) তাঁর উম্মতের পরিণতি নিয়ে তাঁদের ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে যে শাফায়াতগুলো চেয়েছিলেন তা সিজদারত অবস্থাতেই চেয়েছিলেন। জান্নাতেও রাসুল (সা.) এর সান্নিধ্যে থাকার উত্তম উপায় হলো সিজদা।

তাই আসুন আমরাও বেশি বেশি সিজদাহ করে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি। নামাজি ব্যক্তির চেহারায় অন্যদের তুলনায় বেশি লাবণ্য পরিলক্ষিত হয়। তার কারণ সিজদা করার সময় মুখের প্রতিটি শিরায় যথেষ্ট পরিমাণে রক্তের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। যার অভাবে যাঁরা নামাজ আদায় করেন না তাঁদের চেহারায় একধরনের কালচে আভা দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। লাখো কোটি শুকরিয়া সেই মহান রবের যিনি আমাদের এত এত সুন্দর সুন্দর আমল দিয়ে নিজেদের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনকে সুচারুরূপে সাজিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর উচিত বান্দার প্রতি বিধানকৃত ফরজ নামাজ যথাযথ আদায়ের পাশাপাশি অধিক হারে সুন্নাত ও নফল নামাজ আদায় এবং অধিকহারে আল্লাহতাআলাকে সেজদা করা। মুসলিম উম্মাহকে বেশি বেশি সেজদা আদায় সেজদা আদায়ের মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালের মর্যাদা লাভ এবং চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংস্পর্শ লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm