বাকারাহ পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সুরা। মদিনায় নাজিল হওয়া সর্ববৃহৎ সুরা। এই সুরায় তাওহিদের শিক্ষা, কুফর, শিরক ও মুনাফিকের পরিচয় স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান এবং উম্মতে মুহাম্মদির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। কুরআনের প্রত্যেকটা সূরার রয়েছে আলাদা আলাদা নাম প্রেক্ষাপট ও নাযিলের পটভূমি। কোন সূরা বড় কোন সূরা মধ্যম আবার কোন কোন সূরা খুব ছোট। এভাবেই আল্লাহ বৈচিত্রময় করে বিভিন্ন ছোট বড় সূরা দিয়ে সাজিয়েছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এটি কুরআনের সর্ব বৃহৎ সূরা যার আয়াত সংখ্যা রয়েছে ২৮৬ টি। এর শব্দ হচ্ছে ছয় হাজার দুশ একুশটি এবং এতে অক্ষর আছে পঁচিশ হাজার পাঁচশটি। আজ আমরা কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরা সূরা আল-বাকারার ফজিলত ও বরকত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো :
সুরা বাকারাহ সম্মান বৃদ্ধি করে
সুরা বাকারাহ মানুষের সম্মান বৃদ্ধি করে পাঠকারীর নেতৃত্বের সৌভাগ্য নসিব করে। একজন অল্প বয়সী সাহাবি এই সুরার কারণে অভিযানের সর্দার হয়েছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.)বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)একবার এক প্রতিনিধিদলকে এক অভিযানে পাঠালেন। তারা সংখ্যায় ছিলের কয়েকজন। তিনি তাদের কোরআন পাঠ করতে বলেন প্রত্যেকেই যে যা জানত তা পাঠ করে শোনালো। শেষে তিনি এদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী এক ব্যক্তির কাছে এলেন। বলেন হে অমুক তোমার কী আছে ? সে বলল অমুক অমুক সুরা এবং সুরা বাকারাহ আমার জানা আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেন সুরা বাকারাহ তোমার মুখস্থ ? লোকটি বলল হ্যাঁ! তিনি বলেন যাও তুমি তাহলে এ দলের আমির। তখন এ দলের একজন নেতৃস্থানীয় লোক বলল আল্লাহর কসম! রাতের নামাজে তা পড়তে না পারার আশঙ্কায় আমাকে এ সুরাটি শেখা থেকে বিরত রেখেছে। নবীজি (সা.)বললেন তোমরা কোরআন শিক্ষা করো এবং তা পড়ো। কেননা যে ব্যক্তি কোরআন শিখে তা তিলাওয়াত করে এবং নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে তার জন্য কোরআনের দৃষ্টান্ত হলো কস্তুরী ভর্তি চামড়ার একটি থলের মতো। সর্বত্র তার সৌরভ প্রসারিত হয়। আর যে ব্যক্তি তা শিখে ঘুমিয়ে আছে তার দৃষ্টান্ত হলো মুখ বাঁধা কস্তুরীর থলের মতো।
সুরা বাকারাহ ঘরে শয়তানের প্রবেশ রোধ করে
সুরা বাকারাহর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অনেক বেশি। আবু হুরায়রা (রা.)থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন তোমরা তোমাদের বাড়িতে গোরস্তান বানিয়ো না। যে বাড়িতে সুরা বাকারাহ পাঠ করা হয় সে ঘরে শয়তান প্রবেশ করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.)আরো বলেছেন প্রত্যেক জিনিসের উচ্চতা থাকে তেমনি কোরআনের উচ্চতা হচ্ছে সুরা বাকারাহ। যে ব্যক্তি রাতে নিজের নিভৃতকক্ষে তা পাঠ করে তিন রাত পর্যন্ত শয়তান সেই ঘরে যেতে পারে না। আর দিনের বেলায় যদি পড়ে তাহলে তিন দিন পর্যন্ত সেই ঘরে শয়তান পা দিতে পারে না।
সুরা বাকারাহ পাঠে ঘরে বরকতময় হয়
আবু উমামা বাহিলি (রা.)বলেন আমি রাসুল (সা.)কে বলতে শুনেছি তোমরা কোরআন তিলাওয়াত করবে কেননা কিয়ামতের দিন তা তিলাওয়াতকারীদের জন্য শাফায়াতকারী হিসেবে উপস্থিত হবে। তোমরা দুটি সমুজ্জল সুরা বাকারাহ ও আলে-ইমরান তিলাওয়াত করবে কেননা এ দুটি কিয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে যেন দুটি মেঘ খনড কিংবা দুটি ছায়াদানকারী কিংবা যেন দুটি ডানা বিস্তারকারী পাখির ঝাঁক যারা তাদের তিলাওয়াতকারীদের পক্ষে সাহায্যকারী হবে। তোমরা সুরা বাকারাহ তিলাওয়াত করবে কেননা তা তিলাওয়াত করায় বরকত আছে এবং তা বর্জন করা আফসোসের কারণ। কারণ বাতিলপন্থীরা (জাদুকররা) তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না।
আয়াতুল কুরসি সুরা বাকারাহর শ্রেষ্ঠ আয়াত
সুরা বাকারাহর শ্রেষ্ঠ আয়াত হলো আয়াতুল কুরসি। এটাকে সব আয়াতের সর্দার বলা হয়েছে। এই আয়াতের আছে বিশেষ ফজিলত। আবু হুরায়রা (রা.)থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সা.)বলেছেন প্রতিটি বস্তুর শীর্ষদেশ আছে। কোরআনের শীর্ষস্থানীয় সুরা হলো বাকারাহ। এতে এমন একটি আয়াত আছে যা কোরআনের আয়াতগুলোর মধ্যে প্রধান। আর সেটা হলো আয়াতুল কুরসি। আয়াতুল কুরসি আমলের ফজিলত সম্পর্কে আবু উমামা (রা.)থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে জান্নাতে প্রবেশ করতে শুধু তার মৃত্যুই বাধা। অর্থাৎ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
সুরা বাকারাহর শেষ দুই আয়াত
আমানার রাসুলু বিমা উনঝিলা ইলাইহি মিররাব্বিহি ওয়াল মুমিনুন। কুল্লুন আমানা বিল্লাহি ওয়া মালা ইকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসুলিহি লা নুফাররিকু বাইনা আহাদিমমির রুসুলিহি। ওয়া কালু সামিনা ওয়া আতানা গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসির। লা ইউকাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উসআহা-লাহা মা কাসাবাত ওয়া আলাইহা মাকতাসাবাত-রাব্বানা লা তুআখিজনা ইন-নাসিনা আও আখতানা-রাব্বানা ওয়া লা তাহমিল আলাইনা ইসরান কামা হামালতাহু আলাল্লাজিনা মিং ক্বাবলিনা-রাব্বানা ওয়া লা তুহাম্মিলনা মা লা তাকাতা লানা বিহি-ওয়াফু আন্না ওয়াগফিরলানা ওয়ারহামনা-আংতা মাওলানা ফাংসুরনা আলাল কাওমিল কাফিরিন।
দুটি আয়াতের অর্থ হলো
তার প্রতিপালকের কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে রাসুল তার ওপর বিশ্বাস করে আর বিশ্বাসীরাও। তারা সকলেই বিশ্বাস করে আল্লাহয় তাঁর ফেরেশতাগণে তাঁর কিতাবগুলোয় ও তাঁর রাসুলদের ওপর (এবং তারা বলে) আমরা তাঁর রাসুলদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আর তারা বলে আমরা শুনি ও মানি। হে আমাদের প্রতিপালক আমরা তোমার নিকট ক্ষমা চাই আর তোমার কাছেই আমরা ফিরে যাব। আল্লাহ্ কাউকেই তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্বভার দেন না। ভালো ও মন্দ যে যা উপার্জন করবে তা তারই। (তোমরা প্রার্থনা করো) হে আমাদের প্রতিপালক! যদি আমরা ভুলে যাই বা ভুল করি তবে তুমি আমাদেরকে অপরাধী কোরো না। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে যে ভারী দায়িত্ব দিয়েছিলে আমাদের ওপর তেমন দায়িত্ব দিয়ো না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এমন ভার আমাদের ওপর দিয়ো না যা বইবার শক্তি আমাদের নেই। আর আমাদের পাপ মোচন করো আর আমাদেরকে ক্ষমা করো আর আমাদের ওপর দয়া করো তুমি আমাদের অভিভাবক। অতএব অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তুমি আমাদের জয়যুক্ত করো।
সুরা বাকারাহর শেষ দুই আয়াতের ফজিলত
সুরা বাকারাহর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ফজিলতপূর্ণ। ছোট্ট ছোট্ট আয়াতের বড় বড় ফজিলত আছে। শেষ দুই আয়াতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন একবার জিবরাইল (আ.)নবী (সা.)এর কাছে উপবিষ্ট ছিলেন। হঠাৎ ওপরের দিকে তিনি একটি আওয়াজ শুনতে পেয়ে নিজের মাথা তুললেন এবং বললেন এটি আসমানের একটি দরজা যা আজই খুলে দেওয়া হলো। আজকের দিন ছাড়া কখনো তা খোলা হয়নি। তখন সে দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতরণ করলেন। তিনি বললেন ইনি একজন ফেরেশতা। আজ ছাড়া অন্য কখনো তিনি অবতরণ করেননি। এরপর ওই ফেরেশতা সালাম করে বললেন দুটি নুরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন! যা আপনাকে দেওয়া হয়েছে এবং যা আপনার আগে আর কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। তা হলো সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারাহর শেষাংশ। এ দুটির যে কোনো হরফ আপনি পাঠ করবেন তা আপনাকে দিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ এতে যে দোয়ার বিষয়বস্তু আছে তা কবুল করা হবে। এ আয়াত দুটো নিয়মিত পড়লে বিপদ-আপদ দূরে থাকে জান্নাতের পথও সুগম হয়। রাতের বেলা ঘুমানোর পূর্বে সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করলে তাহাজ্জুদ নামাযের সমান সওয়াব পাওয়ার আশা করা যেতে পারে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন যখন আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনটি জিনিস দান করা হয়। ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ২. সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত ৩. এ উম্মতের মধ্যে যারা শিরক করে না তাদের কবিরা গুনাহ মাফ হওয়ার সুসংবাদ। হজরত আলী (রা.)বলেছেন আমার মতে যার সামান্য বুদ্ধিজ্ঞান আছে সে এ দুটি আয়াত পাঠ করা ছাড়া নিদ্রা যাবে না। জুবাইর ইবনু নুফাইর (রা.)থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন সুরা আল-বাকারাকে আল্লাহতাআলা এমন দুটি আয়াত দ্বারা শেষ করেছেন যা আমাকে আল্লাহর আরশের নিচের ভান্ডার থেকে দান করা হয়েছে। তাই তোমরা এ আয়াতগুলো শিখবে। তোমাদের স্ত্রীদেরও শেখাবে। কারণ এ আয়াতগুলো হচ্ছে রহমত (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উপায় ও (দীন দুনিয়ার সকল) কল্যাণলাভের দোয়া। সুরা বাকারার শেষ আয়াত দুটি নিয়ে হাদিসে আরও অনেক ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। বদরি সাহাবি আবু মাসউদ (রা.)থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন সুরা বাকারার শেষে এমন দুটি আয়াত রয়েছে যে ব্যক্তি রাতের বেলা আয়াত দুটি তিলাওয়াত করবে তার জন্য এ আয়াত দুটোই যথেষ্ট। অর্থাৎ রাতে কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করার যে হক রয়েছে কমপক্ষে সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত তিলাওয়াত করলে তার জন্য তা যথেষ্ট। হজরত আলী (রা.)বলেছেন আমার মতে যার সামান্য বুদ্ধিজ্ঞান আছে সে এ দুটি আয়াত পাঠ করা ছাড়া নিদ্রা যাবে না। এ আয়াত দুটো নিয়মিত পড়লে বিপদ-আপদ দূরে থাকে জান্নাতের পথও সুগম হয়।
জান্নাতের পথ সুগম করবে
সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত নিয়মিত পাঠ করলে জান্নাতের পথও সুগম করবে। তার জন্য এটাই যথেষ্ট। রাসুলুল্লাহ (সা.)কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন হে আল্লাহর রাসুল (সা.)কোরআনের কোন সুরা সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান ? তিনি বললেন সুরা ইখলাস। এরপর আবার বললেন কোরআনের কোন আয়াতটি মর্যাদাবান ? তিনি বললেন আয়াতুল কুরসি। এরপর আবার বলেন হে আল্লাহর নবী আপনি কোন আয়াতকে পছন্দ করেন যা দ্বারা আপনার ও আপনার উম্মত লাভবান হবে। নবীজি (সা.)বললেন সুরা বাকারার ২৮৫-২৮৬ নম্বর শেষ দুটি আয়াত। সুরা বাকারা পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সুরা। এ সুরার শেষ দুটি আয়াতের রয়েছে বিশেষ ফজিলত ও তাৎপর্য। নিয়মিত এ অংশের আমল বান্দাকে নানা বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে। জান্নাতের পথও সুগম করবে। সহিহ্ মুসলিমে এ দুটি আয়াতের ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে এ দুটি আয়াত রাসুল (সা.)কে মিরাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে আসমানে দান করা হয়েছে। প্রতিদিন এই দুই আয়াত পাঠের কথা হাদিসে এসেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবাইকে পবিত্র কোরআন শরিফের এ বরকতময় সম্মানিত আয়াত পাঠ এবং আমল করার তাওফিক দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের সব মুসিবত বিপদ-আপদ রোগ-শোক অতিক্রম করে শান্তিময় ও সুখের জীবনলাভে ধন্য করুন। আমিন!
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট