সিন্ডিকেট/ পতেঙ্গায় বেনামি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড লাইটারের আড়ালে জাহাজ কাটে
১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইন গেছে, অথচ পিডিবি জানে না
ছাড়পত্র কিংবা অনুমতির তোয়াক্কা না করেই চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বেনামি একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে আড়াই বছর ধরে প্রকাশ্যে জাহাজ কাটছে একটি সিন্ডিকেট। প্রশাসনের নজর এড়ানোর কৌশল হিসেবে ইয়ার্ডের সামনে রাখা হয়েছে অসংখ্য লাইটার জাহাজ। চট্টগ্রাম বন্দরের জায়গা দখল করে দক্ষিণ পতেঙ্গা বিজয়নগর ঘাট সংলগ্ন নদীর চরে গড়ে ওঠা এই শিপব্রেকিং ইয়ার্ড এলাকার পরিবেশেও ফেলছে বিরূপ প্রভাব।
শিল্প মন্ত্রণালয় তো নয়ই, এমনকি পরিবেশ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরও এই শিপইয়ার্ডের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না কিছুই। শুধু তাই নয়, ইয়ার্ডে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১১ হাজার ভোল্টের বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক সংযোগ। অথচ পিডিবিও এর কিছুই জানে না। অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে অবৈধ এই শিপইয়ার্ডের কর্মযজ্ঞ।
জানা গেছে, দক্ষিণ পতেঙ্গা বিজয়নগর ঘাট সংলগ্ন নদীর চরে প্রায় আড়াই বছর ধরে জাহাজ কাটা ও মেরামতের কাজ করছে নামবিহীন শিপইয়ার্ডটি। চট্টগ্রাম বন্দরের জায়গা দখল করে প্রায় দুই একর জায়গায় গড়ে তোলা হয় এটি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইয়ার্ডটিকে লোকচক্ষুর আড়াল করার কৌশল হিসেবে লাইটার জাহাজ, বল্টগেইট ও বার্জগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন কয়েকশত শ্রমিক সেখানে কাজ করছে। সিন্ডিকেটের নিজস্ব জাহাজ ছাড়াও নদীতে ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোকে এখানে স্ক্র্যাপ করা হয়।
নামবিহীন শিপইয়ার্ডটি পরিচালনা করছে ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। এরা হলেন পতেঙ্গা বিজয়নগর এলাকার বাসিন্দা এয়ার মুহাম্মদ প্রকাশ এয়ারু, মো. বাদশা, জাবেদ ও আবু বকর, আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা সাদেক ও নিজাম।
স্থানীয়রা জানায়, প্রতি মাসে নদীতে ডুবে যাওয়া জাহাজ টেনে এনে ওই ইয়ার্ডে কাটা হয়। এছাড়া প্রতিদিন অকেজো লাইটার জাহাজগুলোও মেরামত করা হয় সেখানে। এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানায়, দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শিপইয়ার্ডটি। জাহাজের বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। গুচ্ছগ্রাম ও বিজয়নগর এলাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রোগের প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের লোকজন। শুধু তাই নয়, পিডিবির কাছ থেকে নেওয়া বিদ্যুতের খুঁটিবিহীন ১১ হাজার ভোল্টের তারের কারণে যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে স্থানীয়রা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে শিপইয়ার্ড সিন্ডিকেটের এয়ার মোহাম্মদ ও মো. বাদশা বলেন, ‘নদীতে ডুবে যাওয়া জাহাজ কাটা ও মেরামতের কাজ করি আমরা। এখানে পরিবেশের সমস্যা হচ্ছে কোথায়?’
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিতরণ (হালিশহর) ডিভিশনের ইনচার্জ মো. গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবৈধভাবে নদীরচরে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই।’ কারা করছে সেটা খবর নিয়ে জানাতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া চট্টগ্রামের আর কোথাও শিপইয়ার্ড স্থাপনের অনুমতি নেই। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে যারাই এ ধরনের কাজে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন্দরের জায়গার মধ্যে অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে কার্যক্রম চালানো দন্ডনীয় অপরাধ। শীঘ্রই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মহানগর) আজাদুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানাবো।’
উল্লেখ্য, গত ৮ ডিসেম্বর (২০১৬) পতেঙ্গা থানার সমুদ্র সৈকত এলাকায় অবৈধভাবে জাহাজ কাটার দায়ে বিপুল পরিমাণ জাহাজ কাটার সরঞ্জামসহ দুলাল মিয়া নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ সময় ১৮টি বড় ও ৮টি মাঝারি আকারের গ্যাস ও সিলিন্ডারসহ প্রায় লক্ষাধিক টাকার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। বিজয়নগর ঘাট সংলগ্ন নদীর চরে গড়ে ওঠা অবৈধ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে এর দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার।