পতেঙ্গার টার্মিনাল নির্মাণে ধীরগতি, ২ বছর শেষে মেয়াদ বাড়ছে ফের

নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হচ্ছে না পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ। প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতার কারণে বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদকাল। তবে মেয়াদকাল বাড়ানো হলেও বাড়ছে না ব্যয়। এছাড়া এ টার্মিনালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে না চট্টগ্রাম বন্দর। এ টার্মিনালে অপারেশনাল কাজে তথা কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে নিজস্ব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে ব্যবহারকারীদের বা বেসরকারি অপারেটরদের। অন্যদিকে, দুই বছর তিন মাস শেষে প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৫০ শতাংশ।

জানা যায়, অধিক সংখ্যক জাহাজ বার্থিং, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ‘পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল’ নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেড থেকে চিটাগাং বোট ক্লাবের মধ্যবর্তী জায়গায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে বিআরটিসি ও বুয়েট।

এক হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য প্রকল্পের মেয়াদকাল ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বছরে এ টার্মিনালের কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা সাড়ে ৪ লাখ টিইউএস। ২০১৭ সালের ১৩ জুন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন হয় এবং ২০১৮ সালের ৩০ জুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হবে ৩২ একর পশ্চাৎ সুবিধাদিসহ ৬০০ মিটার দীর্ঘ জেটি (তিনটি বার্থ), ২২০ মিটার দীর্ঘ একটি ডলফিন জেটি, এক লাখ ১২ হাজার বর্গমিটার আরসিসি পেভমেন্ট (আভ্যন্তরীন ইয়ার্ড এবং রাস্তা), ২ হাজার ১২৮ বর্গমিটার সিএফএস (কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশন) শেড, ৬ মিটার উচ্চতার এক হাজার ৭৫০ মিটার কাস্টমস্ বন্ডেড ওয়াল, ৫ হাজার ৫৮০ পোর্ট অফিস বিল্ডিং, ১ হাজার ২০০ বর্গমিটার যান্ত্রিক ও মেরামত কারখানা, ২ হাজার ৫০০ মিটার রেলওয়ে ট্রাক নির্মাণ, ৪২০ মিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ, ৪ লেন বিশিষ্ট শূন্য দশমিক ৭৫ কিলোমিটার এবং ৬ লেন বিশিষ্ট ১ কিলোমিটার রাস্তা স্থানান্তর পূর্বক পুনঃনির্মাণ, অন্যান্য স্থাপনা যেমন- সিকিউরিটি পোস্ট, গেট হাউস, ফুয়েল স্টেশন, লেবার শেড ইত্যাদি।

এছাড়াও রয়েছে ২টি টাগ বোট ( প্রতিটি ৫০ টন) বিপি, ২টি পাইলট বোট, ২টি ফাস্ট স্পিড বোট ক্রয়। টার্মিনাল পরিচালনার কাজে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি যেমন- ২টি ফায়ার ট্রাক, একটি ফায়ার কার, ৩টি নিরাপত্তা পেট্রোল কার, একটি এম্বুলেন্স, ৪টি কি গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি), ৪টি স্ট্রাডেল কেরিয়ার, ৪টি রিচ স্ট্যাকার, ৮টি রাবার টায়ারড গেন্ট্রি (আরটিজি), ৪টি লো-মাস্ট ফর্ক লিফ্ট, ৪টি ফর্ক লিফ্ট, একটি রেইল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরএমজি) ক্রয়।

নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হচ্ছে না পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ।
নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হচ্ছে না পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ।

প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা
২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে কাজের সাইট হস্তান্তর করা হয়েছে। সেনাবাহিনী কাজের সাইটে অবস্থান নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে স্থায়ী ব্যারাক নির্মাণ, বালি ভরাট, ভূমি উন্নয়ন, নতুন প্রস্তাবিত রাস্তা, বক্স কালভার্ট ড্রেইন নির্মাণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজসমূহ সম্পাদন করছে।

সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে কন্টেইনার জেটি, ডলফিন জেটি, ফ্লাইওভার ও নতুন রাস্তা নির্মাণ কাজ করেছে। প্রকল্প পরিচালনার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রস্তাবিত যন্ত্রপাতিসমূহের মধ্যে ৪টি কিউজিসি ও ৮টি আরটিজি ক্রয়ের জন্য নথি প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ।

জানা যায়, প্রকল্প এলাকা সম্পূর্ণ স্থাপনামুক্ত ছিল না। অর্থাৎ গ্রিন জোন বা ফাঁকা জায়গা পায়নি বন্দর। প্রকল্প এলাকায় রয়েছে পুলিশ বিট, মেরিন ফিশারি, কাস্টম এফ ডিভিশন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি গোডাউন, ওমেরা ফুয়েলের স্থাপনা। ইতোমধ্যে পুলিশ বিট, কাস্টম, মেরিন ফিশারির স্থাপনা প্রকল্প সাইট থেকে অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক জটিলতার কারণে রেড ক্রিসেন্ট এবং ওমেরা ফুয়েলের স্থাপনা এখনো অপসারণ বা স্থানান্তুর করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি। তবে আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে এই সব স্থাপনা অপসারণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, মেয়াদকাল বাড়িয়ে এবং ব্যয় কমিয়ে প্রকল্পের খসড়া আরডিপিপি অনুমোদনের জন্য ইতোমধ্যেই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশোধিত আরডিপিতে প্রকল্প মেয়াদ এক বছর অর্থাৎ আগামী ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে এক বছর। নতুন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয় কমছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

ব্যয় কমার কারণ
সূত্র জানায়, অপারেশনাল কাজের প্রস্তাবিত যন্ত্রপাতি অনুমোদিত ডিপিপিতে ডিপিএম বা ওটিএম পদ্ধতিতে ক্রয়ের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও আরডিপিতে এসওটিতে (সাপ্লাই অপারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফার) সরবরাহের প্রস্তাব করা হয়েছে। কথা ছিল যন্ত্রপাতিগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ক্রয় করবে এবং নিজেদের জনবল দিয়ে চালাবে। কিন্তু নতুন আরডিপি অনুসারে অপারেশন কাজে যেসব যন্ত্রপাতি লাগবে, সেগুলো বেসরকারি ব্যবহারকারী বা অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অর্থায়নে কিনতে হবে। নির্দিষ্ট একটা চুক্তি থাকবে। নির্দিষ্ট সময় পর যন্ত্রপাতিগুলো বন্দরকে হস্তান্তর করতে হবে। যন্ত্রপাতি ব্যয় বাবদ খরচ বাদ দেওয়ার কারণেই প্রকল্পের ব্যয় কমে গেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

প্রকল্পের মেয়াদকাল বাড়ানোর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান সরকার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‌‘প্রস্তাবিত ডলফিন জেটির নির্মাণ কাজের জায়গায় একটি অয়েল জেটি (আরএম-৮) রয়েছে। এই জেটি দিয়ে বাংলাদেশে আমদানিকৃত ভোজ্য তেলের প্রায় ৬০ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। অয়েল জেটি বন্ধ করে অয়েল জেটি নির্মাণ করতে গেলে দেশে ভোজ্য তেলে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এখন যে কোনো একটি কনটেইনার জেটি নির্মাণের পর সেখানে অয়েল জেটিকে স্থানান্তর করে ডলফিন জেটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হবে। এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অয়েল জেটি বন্ধ না করেই প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। বাকি কাজ আরডিপিতে প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি আছে, তা ১৩-১৪ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য ২০২১ সালের মধ্যে নতুন জেটি ও কনটেইনার ইয়ার্ড প্রয়োজন। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য দ্রুততম সময়ে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের মূখ্য উদ্দেশ্য।’

এমএ/এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!