নৌকার বিদ্রোহী/ শেষমেশ ক্ষমা পেলেন চট্টগ্রাম কক্সবাজারের সেই নেতারা
নৌকার বিদ্রোহী হয়ে যারা উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করেছেন, শুরুতে তাদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষপর্যন্ত শেষবারের মতো ক্ষমা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এ ধরনের সব প্রার্থীকে চিঠি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও ইতিমধ্যে ইমেইল ও চিঠি মারফত ক্ষমা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জেনে গেছেন।
আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ‘সাধারণ ক্ষমা’র এই ঘোষণা পেলেন নৌকার বিদ্রোহীরা। আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন চলছে।
নৌকার বিদ্রোহী এমন প্রায় আড়াই হাজার জন শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। ইতিমধ্যে প্রায় আড়াই হাজার বিদ্রোহী প্রার্থীকে ইমেইল ও চিঠি দিয়ে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
আবদুস সোবহান গোলাপ বলেছেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের শেষবারের মতো ক্ষমা করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভবিষ্যতে সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে, তা ক্ষমার অযোগ্য বলে গণ্য করার কথা তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের মধ্যে ১২৬ জন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে যারা বিদ্রোহ করেছে, আমরা সবাইকে শোকজ করেছিলাম, সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমা পাওয়া আড়াই হাজারের মধ্যে জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহীরাও রয়েছে।’
চট্টগ্রামে যারা ক্ষমা পেলেন
চট্টগ্রামে দলীয় পদে থাকার পরও সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করায় জবাবদিহির মুখোমুখি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল। বাঁশখালী উপজেলায় দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও শ্রমবিষয়ক সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম। বোয়ালখালীতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল কাদের সুজন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের এডহক কমিটির সহ সভাপতি শ্রমিক নেতা এসএম নুরুল ইসলাম। এরা প্রত্যেককেই শেষবারের মতো ক্ষমা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
কক্সবাজারে যারা ক্ষমা পেলেন
দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে কক্সবাজার সদর উপজেলা, টেকনাফ, রামু, মহেশখালী ও চকরিয়া উপজেলার পাঁচ আওয়ামী লীগ নেতা শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলে আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামুতে সোহেল সরওয়ার কাজল, মহেশখালীতে শরীফ বাদশা এবং চকরিয়ায় ফজলুল করিম সাঈদী।
শাস্তির মুখোমুখি হয়ে শেষপর্যন্ত ক্ষমা পাওয়া নেতারা হলেন কক্সবাজার সদর উপজেলায় জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য নুরুল আবছার, টেকনাফে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাফর আলম, রামুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল, মহেশখালীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শরীফ বাদশা এবং চকরিয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী।
কক্সবাজার সদর উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী নুরুল আবছার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক কায়সারুল হক জুয়েলের কাছে হেরে যান তৃতীয় স্থান নিয়ে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় স্থান পান। তবে সেখানে নির্বাচিত হয়েছেন আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নুরুল আলম।
অন্যদিকে রামু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও রামু উপজেলা যুবলীগ সভাপতি রিয়াজুল আলমকে হারিয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সোহেল সরওয়ার কাজল। মহেশখালী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ হোছাইন ইব্রাহিমকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন বড় মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শরীফ বাদশা। চকরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করেন।
পেছনের কথা
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৮ বিভাগে আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত দুই শতাধিক নেতার মধ্যে ছিলেন—ঢাকায় সর্বোচ্চ ৪৫ জন এবং চট্টগ্রামে রয়েছেন ১৭ জনেরও বেশি। এছাড়া বিদ্রোহীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার অপরাধে সারা দেশে ৬২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠে।
শুধু আওয়ামী লীগের নয়, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যেসব নেতা উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে কেন তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না—তা জানতে চেয়ে পাঠানো হয় কারণ দর্শানোর নোটিশ।
গত ৫ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যারা উপজেলা নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন, বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হয়, যেসব এমপি-মন্ত্রী নৌকার বিরোধিতা করেছেন বা করবেন, তাদের আগামীতে আর নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
এরপর গত ১২ জুলাই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এছাড়া নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে গিয়ে যেসব মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা কাজ করেছেন, তাদেরও কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে বিদ্রোহী সব প্রার্থীকেই কেন্দ্র থেকে কারণ দর্শাওয়ের চিঠি দেওয়া হয়। পরে কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে বিদ্রোহী সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সিপি