চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য ভেজালমুক্ত খাদ্য ও নিরাপদ পরিবেশসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন উপজেলা প্রশাসন। মাঝেমধ্যে এতে যোগ দিচ্ছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যতক্ষণ স্পটে মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট থাকছেন ততক্ষণ সব ঠিকঠাক থাকছে। ম্যাজিস্ট্রেট গাড়িতে উঠা মাত্রই, দণ্ডপ্রাপ্তরা আগের অবস্থানে ফিরে যান বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভ্রাম্যমান আদালত অনিয়মের কারণে খাদ্য কারখানা, মাংস বিক্রেতা, নদী থেকে বালি উত্তোলন ও অবৈধ কয়লার ডিপোতে দেয়া জরিমানা তথা অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড দিয়েও সুফল মিলছে না। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সিলগালা করেও দেয়া হয় মাঝেমধ্যে। তবে এসব ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের পরও কমছে না অনিয়ম আর অপরাধ।
দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে আসলেই ভেজাল-অনিয়ম কর্মকান্ড কিছু সময় বন্ধ থাকে। ম্যাজিস্ট্রেট সরলেই সব কিছু আগের মতো শুরু হয়।
কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যার গ্রামের মো. শাহাজাহান বলেন, ‘সড়কের জায়গা দখল করে কিছুদিন আগে দোকান তৈরি করেছিলেন কিছু লোক। এমন অভিযোগে ম্যাজিস্ট্রেট কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে ম্যাজিস্ট্রেট স্যার গেলে কাপড় দিয়্যে ঢেকে আড়ালে সড়কের উপর পুনরায় দোকান তৈরি করা শুরু করেছেন। তার মানে যেই লাউ সেই কদু।’
উপজেলা প্রশাসন জান্য, গত বছরের অক্টোবর মাস ও চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত উপজেলায় একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মামুনুর রশীদ, জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী।
এর মধ্যে বেশ আলোচিত অভিযান হলো, কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জ্যারটেক হাক্কানি কর্পোরেশন খাদ্য কারখানাকে পরিবেশের ছাড়পত্রবিহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাছ ও মুরগির খাদ্য তৈরির অপরাধে ২ লক্ষ টাকা জরিমানা ও কাগজপত্র ঠিক করতে তিন মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ৩ মাস ১০ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো চলছে খাদ্য ফ্যাক্টরী আগের নিয়মেই।
এছাড়াও ছাড়পত্র ও অনুমতি ব্যতিত খোলা মাঠে কয়লা, পাথর ও বালি রেখে ব্যবসা করার অপরাধে পুরাতন ব্রিজঘাটের কয়লার ডিপোকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও মেসার্স সাহারা এন্টারপ্রাইজ নামক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে ১ বছর কারাদণ্ড দেন জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত।
কিন্তু সরেজমিনে মঙ্গলবারও দেখা যায়, এখনো কয়লা ও পাথরের ব্যবসা চলছে আগের মতই। এছাড়া জানুয়ারি মাসে কর্ণফুলী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে পাঁচ জনকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী। কিন্তু প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে একই স্থানে এখনো ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের আর কোনো ‘ফলোআপ’ দেখা মিলেনি।
শুধু এসব অভিযান নয়, সিএনজি ও বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, খাদ্যে ভেজাল, ওজনে কারচুপি, সড়ক কিংবা সরকারি জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণসহ কোথাও কোনো অনিয়মের অভিযোগ আসলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেন উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেরা। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের এসব অভিযানেও কমছে না অনিয়ম। তাতে দেখা যায়, এসব অভিযানে যতক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ততক্ষণ নিয়মে বন্দি ছিলেন ব্যবসায়ীরা। ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করে চলে যাওয়ার পর পুনরায় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।
চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত সামাজিক অপরাধ দমনে বেশ ভূমিকা রাখেন। এক ব্যবসায়ি বা এক দোকানদারকে শাস্তি দিয়ে বাকিদের সর্তক করেন। হয়তো জরিমানা বা দণ্ড দেওয়ার পর যদি ফলোআপ রাখা যেত তবে সুফল পাওয়া যেত। এমনও হতে পারে আগের বিচারের ফলোআপ না করায় অপরাধীরা পুনরায় অনিয়মে জড়াচ্ছেন।’
এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘জনবল সঙ্কটের কারণে সব অভিযানের ফলোআপ রাখা সম্ভব হয় না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা চেষ্টা করি অপরাধীদের সংশোধন করতে। মানুষ যদি নিজে সংশোধন না হয়, সেখানে মোবাইল কোর্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন। সুতরাং মানুষকে সচেতন হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন,‘চরপাথরঘাটায় কয়লার ডিপোকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ম্যানেজারকে ১ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো, পরে আপীল করে ৬ মাস কারাদণ্ড কমানো হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। তবে সাত দিনের মধ্যে কয়লা সরাতে বলা হয়েছিলো কিন্তু আমার পক্ষে আর ফলোআপ রাখা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি জানবেন কর্ণফুলী ইউএনও।’
এ বিষয়ে জানতে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মামুনুর রশীদ এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এমএফও