নিপুণ কৌশলে খাতুনগঞ্জের মাল চুরি হয়ে চলে যায় ওপারের ভারতে

সিলেটে সুপারি খুঁজতে গিয়ে বড় চক্রের খোঁজ পেল চট্টগ্রামের পুলিশ

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে ৬০ লাখ টাকা মূল্যের সুপারি বোঝাই করে একটি ট্রাক গত ৮ জুলাই রওনা দেয় সিলেটের কাজীবাজারের উদ্দেশ্যে। একদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও সেই ট্রাক গন্তব্যে না পৌঁছালে ট্রাক ড্রাইভার ও মালিকের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে তাদের মোবাইল বন্ধ পান সুপারি ক্রেতা। পরে দিনভর খোঁজাখুঁজির পর সিলেটের কুলাউড়া থানার একটা রাস্তার পাশে সেই ট্রাকটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পান। কিন্তু ততোক্ষণে তার ৬০ লাখ টাকার ২০০ বস্তা সুপারি তো বটেই, ট্রাকের ড্রাইভার ও মালিক সবাই লাপাত্তা।

পরে আব্দুল ওহাব লিটন (৪০) নামের যে ব্যক্তি ট্রাকটিকে ভাড়া করে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি দ্বারস্থ হন চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার। ১১ জুলাই এই ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন লিটন।

ক্লু-লেস এই মামলাটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন। তার নির্দেশে চালক ও মালিক নিখোঁজ থাকা একটি পরিত্যক্ত ট্রাককে সূত্র ধরেই ৬০ লাখ টাকার সুপারির খোঁজে ১৩ জুলাই রাতেই দুই উপপরিদর্শক মেহেদী হাসান ও মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে কোতোয়ালী থানা পুলিশের একটি টিম।

মামলাটির অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট গিয়ে একদিনের মাথায় লোপাট হওয়া ২০০ বস্তা সুপারির মধ্যে ১৮২ বস্তা সুপারিই উদ্ধার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশের ওই দলটি। শুধু তাই নয়, সামনে চলে আসে এমন একটি চক্রের খোঁজ— যার দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জকে ঘিরে অশুভ এক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাঝেসাঝেই মারা হচ্ছে এমন দাঁও। বড় চালান পৌঁছে দিতে গন্তব্যে যাওয়ার বদলে সীমান্তবর্তী এলাকায় পণ্য খালাস করে সেগুলো ভারতে পাচার করে দেওয়াই এই চক্রটির কাজ। আর এই কাজ পরিচালনা করতে সীমান্তবর্তী হাটগুলোতে রীতিমতো গোডাউন ভাড়া নিয়ে এই কারবার পরিচালনা করে আসছিল তারা।

নিপুণ কৌশলে খাতুনগঞ্জের মাল চুরি হয়ে চলে যায় ওপারের ভারতে 1

প্রযুক্তি ও আন্তরিকতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে মাত্র একদিনের মাথায় সফলভাবে এই অভিযান সম্পন্ন করে কোতোয়ালী থানার দলটি। গ্রেপ্তার করে চক্রের ৩ সদস্যকে। গ্রেপ্তার তিনজন হলেন— মো. ফয়সাল আহমদ (২৭), আজিজুল হক (৫২) এবং লোকমান হোসেন প্রকাশ টুটুল (২৩)।

ট্রাক মালিক ও চালকের যোগসাজশে এই চক্রের সদস্যরা এসব পণ্য সিলেটের জৈন্তাপুর বাজারে খালাস করে রাখতেন নিজেদের গোডাউনে। এরপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেগুলো পাচার করে দেওয়া হতো ভারতে। পরে ট্রাকটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে ছিনতাইয়ের নাটক সাজাতেন ট্রাকচালক ও মালিক। একাধিকবার এভাবেই বড় চালানের মালামাল সরিয়েছে এই চক্রের সদস্যরা। এমনটাই জানা গেছে কোতোয়ালী থানা সূত্রে।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন বলেন, মামলার পর আভিযান চালিয়ে ফয়সাল, আজিজুল ও টুটুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় তাদের কাছ থেকে চুরি করা ১৮২ বস্তা শুকনা সুপারি উদ্ধার করা ছাড়াও ভাড়ায় নেওয়া ট্রাকটি জব্দ করা হয়। তবে এ ঘটনায় জড়িত আরও ৭ জন পলাতক রয়েছে। তাদেরকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি।

ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, এই চক্রটি বিভিন্ন জায়গায় এভাবেই বড় বড় চালানের মালামাল লোপাট করে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে। পরে দেখা যায় ট্রাক পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। ড্রাইভারের নিখোঁজ ডায়েরি করে। আমরা ড্রাইভার ও গাড়ির মালিককে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন থানায় তাদের ছবিও পাঠিয়েছি।

কিভাবে এই সুপারি জব্দ করলেন তার বর্ণনা দিয়ে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কোতোয়ালী থানার উপ পরিদর্শক মেহেদী হাসান বলেন, ‘যখন আমরা মামলার তদন্ত শুরু করি, তখন আমাদের হাতে কোন ক্লুই ছিল না। আমরা শুরুতে ট্রাকটির ট্র্যাকার চেক করি। প্রযুক্তির সাহায্যেই এটি করা হয়। এটা করতে গিয়ে আমরা দেখলাম যে ট্রাকটি কুলাউড়া যাওয়ার আগে জৈন্তাপুরের একটি বাজারে ২ ঘন্টার জন্য থেমেছিল। এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হওয়ায় আমরা জৈন্তাপুর থানায় যাই। তারা আমাদের সহযোগিতা করে। তারা জানায় জৈন্তাপুর থেকে ভারতে বিভিন্ন মালামাল পাচার করা একটি চক্র আছে। আমরা তাদের খোঁজে আরও অনুসন্ধান করি। ১৪ জুলাই পুরোদিন আমরা শুধু তথ্য সংগ্রহ করি। আমরা জানতে পারি সিদ্দিক, দুলাল, সামশু ও শাহীন নামের ৪ জন এই চক্রটি পরিচালনা করেন। পরে আমরা প্রথমে সিদ্দিকের দোকানে অভিযান পরিচালনা করে সেখানে আধা বস্তা সুপারি পাই।’

উপপরিদর্শক মেহেদী হাসান বলেন, ‘পরে দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে ওই জৈন্তাপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মো. ফয়সাল আহমদ, আজিজুল হক ও লোকমানকে গ্রেপ্তার করি। এ সময় তাদের গোডাউন থেকে চুরি করা ১৬২.৫ বস্তা শুকনা সুপারি উদ্ধার করা হয়। পরে আসামিদের তথ্য মতে কানাইঘাটের বীরদল কালুমোড়ের শাহীন ও সামছুলের যৌথ গোডাউন থেকে আরও ২০ বস্তা সুপারি উদ্ধার করি।’

প্রাথমিকভাবে তারা জানিয়েছে, খাতুনগঞ্জকে ঘিরে ট্রাক চালক ও মালিকদের সম্পৃক্ত করে এই কাজটি করে আসছে তারা। এর আগে তারা চিনিসহ আরো বিভিন্ন পণ্যের চালান একই কায়দায় লোপাট করে।

এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে ট্রাকমালিক ভুট্টো মানিক ও ড্রাইভার জাহাঙ্গীর ছাড়াও সিদ্দিক, শাহিন, শেবলু মিয়া, সামছুল এবং দুলাল পলাতক রয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।।

এছড়াও সুপারিগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় এর মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান কোতোয়ালী থানার উপ পরিদর্শক মেহেদী হাসান।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!