নারী সহকর্মীদের ‘হেনস্তা’ করেন চট্টগ্রামের শীর্ষ সমন্বয়করা, বিরুদ্ধ মত দমাতে কিশোর গ্যাং
সমন্বয়কদের খেদমতে আওয়ামী লীগ নেতার ‘ডট গ্যাং’
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নারী সমন্বয়কদের হয়রানি করছেন শীর্ষস্থানীয় পুরুষ সমন্বয়করা। কোনো বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করলেই তাদের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং লেলিয়ে দেওয়া, অনলাইনে হয়রানিসহ অন্যান্য সমন্বয়কদের দিয়ে অপদস্ত করা হয়। এমন সব অভিযোগ তুলেছেন নারী সমন্বয়করা। অন্যদের পাশাপাশি এমন অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির বিরুদ্ধেও। কয়েকজন সমন্বয়কের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগও মিলেছে এর পাশাপাশি।
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক অতিরিক্ত স্বেচ্ছাচারী আচরণ করছেন— এমন অভিযোগ তুলে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নারী সমন্বয়ক নাফিজা সুলতানা অমি জানান, কোনো কোনো সমন্বয়কের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করলে বা সেসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে অন্য সমন্বয়কদের বিভিন্নভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন নারীরা। শনিবার (৯ নভেম্বর) রাতে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে নাফিজা সুলতানা অমি বলেন, ‘প্রতিবাদ করার ফলে ভাইদের যতোটা না অপমান-অপদস্থ করেছে, তার থেকেও বেশি অপমান-অসম্মান করা হয়েছে নারীদের। এমনকি যে বোনেরা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাদেরকেই তারা বাজে ইঙ্গিত, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা এমনকি বডি শেমিং করতেও ছাড় দেয়নি। কিশোর গ্যাংকে বৈধতা দিয়ে একজন নারীকে কীভাবে সাইবার বুলিংয়ের জন্য লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটার প্রমাণও হাতে আছে।’
কী ধরনের অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সমন্বয়কদেরকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে তার বিবরণও দিতে গিয়ে অমি বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে সমন্বয়কদের ৩২ জনের একটা টেলিগ্রাম গ্রুপ ছিল। সেই গ্রুপে হুট করে সদস্য বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ৮০-৮১ তে গিয়ে ঠেকেছে। এদের মধ্যে উদয় হয়েছে ক্ষ্যাতনামা (খ্যাতনামা’র ব্যঙ্গার্থ) মাস্টারমাইন্ডরা এবং উড়ে এসে জুড়ে বসা সমন্বয়কবৃন্দ। ব্যাপারটা এইটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এতটুকুতেই ঠেকেনি। শুরু হয় স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ফুটেজবাজি, সমন্বয়হীনতা এবং চবিকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট। সব স্থানেই এই তিন ক্যাটাগরির মানুষরাই প্রায়োরিটি পেতে থাকে। এসবের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে অপমান-অপদস্থ করে গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ট্যাগ লাগিয়ে দেয় স্বার্থান্বেষী অথবা ছাত্রলীগের হেল্পার।’
এদিকে এমন সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের সমন্বয়কদের একটি অংশ কেন্দ্রে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এসব অভিযোগের বিষয় মীমাংসা করতে চট্টগ্রামের সকল সমন্বয়ককে ১০ নভেম্বর ঢাকায় ডেকেছিল কেন্দ্রীয় কমিটি। তবে ওই সভায় যাতে চট্টগ্রাম থেকে কেউ যোগ না দেয় সেই বিষয়ে বাকি সমন্বয়কদের চাপ দেন রাফি— এমন কথা জানিয়েছেন কয়েকজন সমন্বয়ক। শেষ পর্যন্ত সভাটি আর হয়নি।
নাফিজা সুলতানা অমি বলেন, ‘এসবের প্রেক্ষিতে সমন্বয়ক গ্রুপে কথা বলতে গিয়ে রাফির ঘনিষ্ঠ সমন্বয়কদের দ্বারা অমি বিভিন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ আক্রমণের শিকার হয়েছি।’ অমি বলেন, ‘এ সবকিছু দেখার পরেও আমাদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি একদম নিশ্চুপ ছিল। নারীদেরকে যেভাবে অপমান, অপদস্থ করা হয়েছে এবং যারা করেছে তাদের সাথেই রাফির ওঠাবসা সবসময়ই।’
এদিকে বিক্ষুদ্ধ সমন্বয়করা অভিযোগ তুলেছেন, নির্দিষ্ট গ্রুপের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করলেই তাদের বিরুদ্ধে ডট গ্যাং নামে একটি কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যদের লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের আলোচিত কিশোর গ্যাং ‘ডট গ্যাং’য়ের সদস্য নগরীর স্বনামধন্য তিনটি স্কুলের অন্তত ৪০ শিক্ষার্থী। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই গ্যাং-এর সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তখন র্যাব জানিয়েছিল, ওই সাতজনই চট্টগ্রাম নগরের স্বনামধন্য স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। তাদের কারও বাবা চিকিৎসক, আবার কারও বাবা সরকারি কর্মকর্তা। তাদের সবার বয়সও অভিন্ন— ১৬ বছর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় দেড় বছর আগে ‘ডট গ্যাং’ নামে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে মূলত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ‘হিরোইজম’ দেখানোর লক্ষ্য নিয়ে। সেই থেকে তারা স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উত্যক্ত, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, মারামারিসহ বিভিন্ন অপরাধ করে আসছিল।
ছাত্রলীগ নেতা নামধারী কয়েকজন ‘বড় ভাই’ এই কিশোর অপরাধীচক্রের মূল মদদদাতা জানিয়ে র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল মাহবুব আলম ওই সময় জানিয়েছিলেন, ‘যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে মদদদাতা হিসেবে কয়েকজন তথাকথিত বড় ভাইয়ের নাম পেয়েছি। এরাই তাদের আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে জমি দখল, মারামারি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে। এসব মদদদাতার কারও কারও রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আবার মদদদাতাদের যারা কথিত বড় ভাই তাদের মধ্যে প্রভাবশালী রাজনীতিক আছে।’
গণঅভ্যূত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি ও তার ঘনিষ্ঠ অন্য আরেক সমন্বয়ক রিজাউর রহমানের বিরুদ্ধে ‘ডট গ্যাং’ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ডট গ্যাং-এর সদস্যদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের বেশ কিছু প্রমাণ এর মধ্যেই চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে।
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি সবসময় গণআন্দোলনে নারীদের যে ভূমিকা, সেটা তুলে ধরার ও তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়েছি। এই সময়ে এসে তারা আগের মতো আর সেভাবে আমাদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত থাকতে পারছে না। আমি আমার অবস্থান থেকে চেষ্টা করি তাদের সম্পৃক্ত রাখার।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী সমন্বয়কদের আনা অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় এই সমন্বয়ক বলেন, ‘অভিযোগগুলো অনেকাংশে সত্য। তবে যার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ উঠেছে— এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়াই ভালো হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে খান তালাত মাহমুদ রাফির সঙ্গে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া মেলেনি।
সিপি