নাছিরের স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছেন নওফেল, কমিটির দৌড়ে অনুসারীদের কপাল পুড়ছে

ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগে মহিউদ্দিন বলয়ের আধিপত্য

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তৃণমূল পর্যায়ে বরাবরই দলটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের রয়েছে বড় প্রভাব। তার অনুসারীর সংখ্যাও বিশাল। কিন্তু অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলোতে বেশ কয়েক বছর ধরেই স্থান পেতে নাছির অনুসারীদের রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। নগর ছাত্রলীগ থেকে যুবলীগ, এমনকি সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবক লীগের নগর কমিটিতেও একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যাচ্ছে দলটির প্রয়াত নগর সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের— যে ঘরানার হাল ধরেছেন এখন তারই বড় ছেলে উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। নগরের রাজনীতিতে সমান সমান প্রভাব, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিমাত্রায় তৃণমূল ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরও কমিটির বেলায় এসে কেন নাছির অনুসারীদের কপাল পুড়ছে— এ নিয়ে দু পক্ষের নানা মত রয়েছে।

আগে দেখা যেতো, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে ভারসাম্য থাকতো। সভাপতি এক বলয় থেকে করা হলে সাধারণ সম্পাদক পদ পেতেন আরেক বলয়ের নেতা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পুরনো রীতি থেকে বেরিয়ে সেই ভারসাম্য আর রাখা হচ্ছে না।

এর আগে চট্টগ্রাম মহানগরে আওয়ামী লীগের যেসব অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি হয়েছে, তার সবকটিতেই কেন্দ্রের ‘সুনজর’ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন আ জ ম নাছিরের অনুসারীরা। সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবক লীগের চট্টগ্রাম নগর কমিটির বেলায়ও ঘটেছে একই ঘটনা।

দীর্ঘ দুই দশক পর হওয়া চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন ২০ জন নেতা। এর মধ্যে সাতজন ছাড়া আর বাকি ১২ জনই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারী। কমিটিতে স্থান পাওয়া ১১ সহ-সভাপতির মধ্যে মাত্র তিনজন আ জ ম নাছিরের অনুসারী। এরা হলেন— হেলাল উদ্দিন, সুজিত দাশ, আবদুর রশিদ লোকমান। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে স্থান পাওয়া তিনজনের মধ্যে নাছির অনুসারী মাত্র একজন। তিনি আব্দুল্লাহ্ আল মামুন। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে স্থান পাওয়া তিনজনের মধ্যে নাছির অনুসারী অবশ্য দুজন। তারা হলেন— মাছুদ খান ও সালাহ উদ্দীন শেরশাহ।

অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২০ সদস্যের কমিটিতে সর্বোচ্চ দুটি পদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৩টি পদই পেয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারীরা।

নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর অনেকটাই ভেঙে পড়ে তার নিয়ন্ত্রিত গ্রুপটি। অনেকে করেন পক্ষবদলও। পরে গ্রুপটির হাল ধরেন তার বড় ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। রাজনীতিতে তুলনামূলক অনভিজ্ঞ নওফেলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়ে অনেকটা স্বস্তিই কাজ করছিল নাছির শিবিরে। মহিউদ্দীন চৌধুরীর মত শক্ত হাতে রাজনীতি করা বা কমিটিতে প্রভাব বিস্তার করার মতো কাজ নওফেলকে দিয়ে হবে না— এমন চিন্তা করে মহিউদ্দিন গ্রুপের অনেক পুরনো নেতাকেও নাছির গ্রুপে ভিড়তে দেখা যায়।

কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদের মনোনয়নে ‘অখ্যাত’ রেজাউল করিম চৌধুরী সামনে আসার পর নগর রাজনীতিতে মহিউদ্দীন চৌধুরীর গ্রুপটি নওফেলকে সামনে রেখে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এরপর থেকে নগরে গঠিত বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কমিটিতে নওফেল অনুসারীরা স্থান পেতে থাকেন বড় ব্যবধানে।

এর আগে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের বেশিরভাগ পদ যায় মহিউদ্দিন গ্রুপের ঘরে। যুবলীগের বেলায়ও ঘটে একই ঘটনা। চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সর্বশেষ কমিটির আহ্বায়ক ছাড়াও ৪ যুগ্ম-আহ্বায়কের ৩ জনই মহিউদ্দীন চৌধুরীর ‘খাস লোক’ হিসেবে পরিচিত।

তবে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তৃণমূল পর্যায়ে বরাবরই আ জ ম নাছিরের বড় প্রভাব রয়েছে। তার অনুসারীর সংখ্যাও বিশাল।

কিন্তু কমিটির বেলায় কেন নাছির অনুসারীদের স্থান পেতে গলদঘর্ম হতে হয়— এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে কথা হয় চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে অভিজ্ঞ একাধিক প্রবীণ নেতার সঙ্গে।

তাদের ভাষ্য, চট্টগ্রামের রাজনীতিতে মহিউদ্দীন চৌধুরীর বিকল্প কেউ কখনোই কেউ হতে পারবে না। তাই মহিউদ্দিনের প্রতি সম্মান রাখতেই কমিটিতে তার অনুসারীদের ওপর তুলনামূলক বেশি আস্থা রাখছে কেন্দ্র।

তারা বলেন, গত কয়েক বছরে উপমন্ত্রী নওফেল কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্য রেখে সেখানে নিজের একটি প্রভাববলয় তৈরি করেছেন। একদফায় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে সেই সখ্য আরও ঝালাই করে নেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরে কমিটি গঠনের বেলায় সেই প্রভাব ও সখ্য বেশিরভাগ সময়ই ফলদায়ক হচ্ছে।

তবে আ জ ম নাছিরের অনুসারী নেতারা এসব যুক্তি মানতে নারাজ। তার বলছেন, আ জ ম নাছিরকে কোণঠাসা করতে ষড়যন্ত্র অতীতে যেমন হয়েছে, হচ্ছে এখনও। নগরে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতেও নাছির অনুসারীদের কোণঠাসা করে কেউ কেউ নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে চাইছেন। তবে পদ-পদবির বাইরে গিয়ে আ জ ম নাছির যেমন দীর্ঘদিন নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্যূত করেননি, তেমনই পদ-পদবি না পেলেও তার অনুসারীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিই আঁকড়ে থাকবেন।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গত নির্বাচনে কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে আ জ ম নাছির ও নওফেল গ্রুপের স্নায়ুযুদ্ধ প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য রূপ নেয়। একই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নগর আওয়ামী লীগের ইউনিট সম্মেলন চলাকালে দুই গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা গেছে স্পষ্টভাবে।

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই মহিউদ্দিন চৌধুরী পুত্র মহিবুল হাসান নওফেলকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতা অনেকটা গোপনে বৈঠকে বসেন নগরীর এক বাসায়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিনের চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারের বাসায় প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপি এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে। ওই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এবং বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান চৌধুরী। ওই বৈঠকের কথা জানাজানি হতেই নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারীরা একে ‘ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক’ দাবি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে ওঠেন। তাদের কেউ কেউ খোরশেদ আলম সুজনকে ‘রাজ্জাকি বাকশালী’ বলে অভিহিত করে আবদুচ ছালামকেও ‘সুবিধাবাদী’ বলে ক্ষোভ ঝাড়েন। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, মূলত আ জ ম নাছিরকে ঠেকানোর অংশ হিসেবেই তারা দফায় দফায় গোপন বৈঠকে বসছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন।

ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের প্রায় ১০০টি ইউনিটের সম্মেলন হয়েছে। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় ইউনিটেই আবার আ জ ম নাছির অনুসারীরা একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে। এখন পর্যন্ত এটাই নাছির বলয়ের অর্জন। যদিও মহিউদ্দিন অনুসারীরা এসব সম্মেলন একতরফাভাবে করা হয়েছে— এমন অভিযোগ এনে কেন্দ্রের কাছে নালিশও তুলতে দেরি করেনি।

সেই নালিশের জের ধরে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি ঢাকার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা চট্টগ্রামের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায়ও বসেন। নানা সমীকরণের পর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি এখন আগামী মার্চকে সামনে রেখে সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানেই মূলত দুই গ্রুপের লড়াইয়ের চূড়ান্ত রূপটি দেখা যাবে— আভাস দিচ্ছেন শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!