ধর্ষণকাণ্ড ও লোভের মাশুল দিচ্ছে কক্সবাজারের পর্যটন, ভরা মৌসুমেই রুম খালি অর্ধেক

হোটেলে নারী পর্যটক ও স্কুলছাত্রী ধর্ষণ ছাড়াও রেস্টুরেন্ট ও হোটেলগুলোয় দাম নিয়ে নৈরাজ্যের প্রভাব শেষ পর্যন্ত পড়েছে কক্সবাজারের পুরো পর্যটনখাতেই। শীতে পর্যটনের এমন ভরা মৌসুমেই অন্তত ৫০ ভাগ হোটেলেরই রুম খালি পড়ে আছে। বছরের শেষ দিন ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপনেও পর্যটকের দেখা মেলেনি সেভাবে। অথচ অন্যান্যবার হোটেলে রুম পেতেই গলদঘর্ম হতে হতো পর্যটকদের। এমন পরিস্থিতিতে চিন্তার ভাঁঁজ পড়েছে কক্সবাজারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কপালে। তারা বলছেন, পর্যটনের এমন ভরা মৌসুমে পর্যটকের দেখা না মেলা সত্যিই উদ্বেগজনক।

গাড়ি পার্কিং পর্যটন গলফ মাঠের ইজারাদার কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর সালাহউদ্দিন সেতু সংবাদসংস্থা ইউএনবিকে বলেছেন, গত ১৬ ডিসেম্বর ছুটির ৩ দিনে পর্যটকদের বড় বাস পার্কিং ছিল সাড়ে ৩০০টি। পার্কিং জায়গা না পেয়ে স্থানীয় ইলিয়াছ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে আরো আড়াইশত বড় বাস পার্কিং করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ৭০০ বাস কক্সবাজারে পার্কিং হয়। কিন্তু এবারে বছরের বিদায় ও বরণ উপলক্ষে কক্সবাজারে পর্যটকদের বড় বাস পার্কিং করা হয় ৫০টির মতো। এ থেকে বোঝা যায়, অন্যান্য ছুটির সময়ের তুলনায় এবার পর্যটক আসেনি বললেই চলে।

ধর্ষণকাণ্ড ও লোভের মাশুল দিচ্ছে কক্সবাজারের পর্যটন, ভরা মৌসুমেই রুম খালি অর্ধেক 1

তিনি বলেন, এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটক ব্যবসায়ীরা। মূলত থার্টি ফার্স্ট নাইটকে উপলক্ষ করে পার্কিং ইজারা নেওয়া হয়। এতে এবার কাঙ্খিত ফল মেলেনি।

তার ধারণা, মূলত নারী পর্যটক ধর্ষণ ও ডাল-ভাতের দাম বেশি নেওয়ার ঘটনা ভাইরাল হওয়ার কারণে এবার কক্সবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পর্যটকরা।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ অবশ্য বলেছেন, সম্প্রতি কক্সবাজারকে নিয়ে প্রচারণায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও পর্যটকদের সেবার মান বাড়াতে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একাধিক বৈঠকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শুধু থার্টি ফার্স্ট নাইট বা বর্ষবরণ নয়, ভরা পর্যটন মৌসুমে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

এর মধ্যেই গত ২৯ ডিসেম্বর সৈকতে নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা ‘সংরক্ষিত এলাকা’ উদ্বোধন করে সমালোচনার মুখে পড়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। পরে ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার ইউএনবিকে বলেছেন, এবার আশানুরূপ পর্যটক আসেনি। থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে মাত্র ৫০ শতাংশ রুম বুকিং হয়েছে। সৈকতে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান আয়োজনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোনো আয়োজন ছিল না। তাই এবার কক্সবাজারে পর্যটক আগমন আশানুরূপ হয়নি। তবে এবার অনেক আবাসিক হোটেলে বেশি কিছু বিদেশি পর্যটক রুম বুকিং নিয়েছেন।

তিনি জানান, এবার ধর্ষণের ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে। বছর বিদায় ও বরণের এমন সময়ে কক্সবাজারে এমন নাজুক অবস্থা আর হয়নি।

আবাসিক হোটেল অফিসার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ জানান, এখন সব হোটেল অনলাইনে বুকিং নিচ্ছে। তাই কোনো দালালের কাছে না নিয়ে গিয়ে সরাসরি হোটেল বুকিং দিলে সাশ্রয় রেটে রুম দেওয়া সম্ভব। তবে এবার কাঙ্খিত পর্যটকের আগমন হয়নি। তবে খুশির খবর হচ্ছে এবার অন্যান্যবারের তুলনায় কিছু বিদেশি পর্যটক বেশি এসেছেন।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, সম্প্রতি সময়ে কক্সবাজারে ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই অনেকে এই বিষয়কে মাথায় রেখে কক্সবাজার ভ্রমণ বাতিল করেছে। তবে একটা ঘটনাকে নিয়ে কক্সবাজার সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা করা উচিত নয়।

কক্সবাজারে নারী পর্যটক ধর্ষণের ঘটনা ও এর পরবর্তী কিছু ঘটনাপ্রবাহে বিতর্কের মুখে পড়েছে কক্সবাজারের টুরিস্ট পুলিশ। টুরিস্টের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, কক্সবাজারের সাড়ে ৪০০ আবাসিক হোটেলে প্রায় দেড় লাখ লোক রাত্রিযাপন করতে পারেন। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি হোটেলে সিসিটিভি ক্যামেরা নিশ্চিত করা হয়েছে। শৃঙ্খলা রক্ষায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, সাদা পোশাকধারী পুলিশ সব সময় মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। কক্সবাজারে ৩৫টি পর্যটন জোন রয়েছে । প্রত্যেক পর্যটন জোনে ট্যুরিস্ট পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা ও পর্যটকদের নিরাপত্তায় কয়েক স্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কক্সবাজারে যাতে আর কোন নেতিবাচক না ঘটে সেই জন্য সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে পুলিশ।

কক্সবাজারে স্বামী ও সন্তানকে আটকে রেখে এক নারী পর্যটককে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ২৫ বছর বয়সী ওই নারীর অভিযোগ, সংঘবদ্ধ একটি চক্র গত ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্ট থেকে তাকে তুলে নেয়। তার স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে এবং হত্যার হুমকি দিয়ে তাকে কয়েক দফা ধর্ষণ করে তিনজন। পরে খবর পেয়ে জিয়া গেস্ট ইন নামের এক হোটেল থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করে র‌্যাব। পরদিন ওই নারীর স্বামী চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি আশিকুল ইসলাম আশিক, ২ নম্বর আসামি ইসরাফিল হুদা জয়সহ এজাহারভুক্ত চার আসামি এবং সন্দেহভাজন হিসেবে আরও তিনজনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আশিককে ২৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, চাঁদা ‘না দেওয়ার’ কারণে কক্সবাজারে ওই নারী পর্যটককে ধর্ষণ করার কথা আশিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আশিকের সঙ্গে ওই নারীর আগে থেকেই পরিচয় ছিল, যদিও ওই নারী তা অস্বীকার করেছেন। সেই ট্যুরিস্ট পুলিশই এখন মামলাটি তদন্ত করছে।

কক্সবাজার সৈকতের কলাতলীর একটি হোটেলকক্ষে আটকে রেখে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের আরেক ঘটনা প্রকাশ পায় এর মধ্যেই। মামলার এজাহার অনুযায়ী, ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরার পথে কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের নজরুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ আশিকসহ চার যুবক ওই ছাত্রীকে গাড়িতে তুলে অপহরণ করেন। পরে তাকে সৈকতের মমস গেস্ট হাউসে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর রাতে একটি গাড়িতে করে ভুক্তভোগীকে তার বাড়ির সামনে রেখে গা ঢাকা দেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। এরপর ওই ছাত্রীকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। গত ২৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা থেকে মামলার প্রধান আসামি মোহাম্মদ আশিককে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এর আগের দিন রাতে কক্সবাজার শহর থেকে এজাহারভুক্ত আসামি মো. কামরুল ও মমস রিসোর্টের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহীনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!