দেশ থেকে মেয়ে বাগিয়ে দুবাইয়ে চট্টগ্রামের তিন ভাইয়ের ‘মধুচক্র’

আজম ধরা পড়লেও নাজিম ও এরশাদের ‘ব্যবসা’ চলছেই

কিশোরীটি পড়তেন নবম শ্রেণিতে। এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগের সঙ্গে। একপর্যায়ে তিনি দুবাইয়ের হোটেলে ভালো চাকরির লোভ দেখান ওই কিশোরীকে। এই টোপ গেলা মাত্রই ইভান শাহরিয়ার সোহাগ কিশোরীকে পরিচয় করিয়ে দেন দুবাইয়ে নারীপাচারের ‘গডফাদার’ আজম খানের ভাই নাজিমের সঙ্গে। অনেকটা চোখের পলকে পাসপোর্ট-ভিসা-টিকেট তৈরি হয়ে যায় ওই কিশোরীর। অনেক আশা নিয়ে প্লেনে চড়ে দুবাই পৌঁছেই বুঝতে পারেন, কতো বড় ভুল তিনি করে ফেলেছেন! কিশোরীর স্থান হয় দুবাইয়ের সিটি টাওয়ার হোটেলের একটি বদ্ধ কক্ষে— যাতে কোনো জানালা ছিল না। ওই কিশোরীর মতো আরও ২০ নারী তখন ওই হোটেলে জায়গা পেয়েছিল তারই মতো জানালাবিহীন বদ্ধ কক্ষে।

সবগুলো মেয়েরই দিন শুরু হতো রাত নয়টা থেকে। সিটি টাওয়ার হোটেলের বলরুমে ভোর চারটা পর্যন্ত তাদের নাচতে হতো আরবি, হিন্দি ও ইংরেজি গানের সঙ্গে। আবার বলরুমে আসা কোনো গেস্ট যদি এই মেয়েদের কারও সঙ্গে রাত কাটাতে চাইতেন, তখনও তাদের সঙ্গে রুমে যেতে হতো। এজন্য দুবাই ক্লাবের সুপারভাইজার আলমগীর ২ হাজার ২০০ দিরহাম (বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার) নিতেন ‘খদ্দের’ থেকে। কোনো মেয়ে রুমে যেতে না চাইলে আলমগীর কোমরের বেল্ট ও শক্ত লাঠি দিয়ে তাকে পেটাতেন।

নবম শ্রেণীর ছাত্রী সেই কিশোরীর ভাগ্য তবু ভালো। দুঃসহ দিন-রাত কাটানোর পর চার মাস আগে দুবাইয়ে বাংলাদেশের কনস্যুলার জেনারেল অফিসের সহায়তা নিয়ে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সম্প্রতি ফিরে আসেন বাংলাদেশে। হয়তো তিনি যেদিন দুবাই থেকে ফিরে আসেন, সেদিনই হয়তো অন্য কোনো শিকার ‘ভালো চাকরি’র আশায় দুবাইয়ের ফ্লাইটে চড়ে বসেছেন।

বাংলাদেশে মেয়ে সংগ্রহের কাজটি করতেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ার সোহাগের মতো আরও অনেকেই।
বাংলাদেশে মেয়ে সংগ্রহের কাজটি করতেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ার সোহাগের মতো আরও অনেকেই।

দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে এই নারীপাচার ও যৌনচক্রের তিন মূল হোতাই চট্টগ্রামের। তিনজনই আপন ভাই। এদের মধ্যে দুবাই পুলিশের দেওয়া তথ্য ধরে ঢাকা সিআইডি গত জুলাই মাসে গ্রেপ্তার করে ‘গডফাদার’ আজম খানকে। তার অন্য দুই ভাই নাজিম উদ্দিন ও এরশাদ এখনও দুবাইয়ে ‘যৌনব্যবসা’ চালিয়ে যাচ্ছেন। বছরের পর বছর বাংলাদেশ থেকে পাঠানো নারীদের এই তিন ভাই মিলে দুবাইয়ের হোটেল ও ড্যান্স বারে যৌনকর্মে বাধ্য করতেন। টাকার বিনিময়ে এই তিন ভাইয়ের প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশে মেয়ে সংগ্রহের কাজটি করতেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ার সোহাগের মতো আরও অনেকেই। দেশজুড়েই সংঘবদ্ধ এই চক্র। দেশের বিভিন্ন নৃত্য সংগঠন ও ক্লাব থেকে তারা মেয়ে সংগ্রহ করতেন। গায়েহলুদসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যারা পেশাদার হিসেবে নাচেন, তারাই ছিলেন এদের মূল শিকার। এছাড়া চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলা থেকেও নানা কৌশলে নারী সংগ্রহ করা হতো।

জীবনের শুরুতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা আজম খানের পরিচিতি ছিল ছিঁচকে চোর হিসেবে। একসময় হয়ে ওঠেন থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। র‌্যাব ও পুলিশের তাড়ায় একপর্যায়ে পালিয়ে চলে যান দুবাই। সেখানে গিয়ে ধীরে ধীরে তার ভাগ্য খুলতে শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে নারী পাচার করে সেখানে যৌনব্যবসার জাল বিছিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন রাতারাতি বিত্তশালী। দুবাইয়ে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেলের মালিক আজম খান। তার মালিকানাধীন হোটেলগুলো হলো ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার। বছর পাঁচেক আগে দুবাইয়ে আজম খানের হোটেল থেকে লাফিয়ে পড়ে এক নারীর আত্মহত্যার ঘটনায় তাকে আমিরাত থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি চলে যান ওমানে। সেখানেও আগে থেকেই তার নারীপাচারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিল।

নারীপাচার ও যৌনকর্মে বাধ্য করার এই নেটওয়ার্কে শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন আজম খানের দুই আপন ভাই— নাজিম উদ্দিন ও এরশাদ। তিনজনই চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কেরি মুহুরী বাড়ির মাহবুবুল আলমের ছেলে। ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় আজম খানের বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যা মামলাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে।

দুবাই পুলিশের দেওয়া তথ্য ধরে ঢাকা সিআইডি গত জুলাই মাসে গ্রেপ্তার করে ‘গডফাদার’ আজম খানকে।
দুবাই পুলিশের দেওয়া তথ্য ধরে ঢাকা সিআইডি গত জুলাই মাসে গ্রেপ্তার করে ‘গডফাদার’ আজম খানকে।

পুলিশ জানিয়েছে, বাংলাদেশে এই তিন ভাইয়ের প্রতিনিধিরা প্রথমে হোটেলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০-২২ বছর বয়সী তরুণীদের সামনে টোপ ফেলতো। বিশ্বাস অর্জনের জন্য বেতন হিসেবে ২০-৩০ হাজার টাকা নগদ পরিশোধও করা হতো। এমনকি দুবাইয়ে যাওয়া-আসা বাবদ সব ধরনের খরচও দিত ওই দালালচক্র। এভাবে গত অন্তত আট বছরে চাকরির লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশের কয়েকশত তরুণী-কিশোরীকে দুবাইয়ে পাচার করা হয়েছে। অনেক মেয়েকে আবার পাচার করা হয়েছে ওমানেও।

ঢাকার আদালতে নারী পাচারচক্রের ‘গডফাদার’ আজম খান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, চট্টগ্রামের মাহফুজ, লালবাগের স্বপন, আলামিন ওরফে ডায়মন্ড, বংশালের ময়না ও ময়মনসিংহের অনীক তাকে মেয়ে সংগ্রহের কাজে সাহায্য করেছেন।

অন্যদিকে আজমের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া তার ভাই নাজিমের বন্ধু মো. ইয়াছিন ও নির্মল ড্যান্স একাডেমির নির্মল সরকার তাদের দেওয়া জবানবন্দিতে আরও দুই ‘গডফাদারের’ নাম জানিয়েছেন। এরা হলেন ঢাকার বাড্ডার সজীব ও ময়মনসিংহের অনীক। দুবাইতে এ দুজনেরও ড্যান্স বার আছে। আজম খানের ড্যান্স বার ছাড়াও তারা সজীব ও অনীকের ড্যান্স বারের জন্যও নারী সরবরাহ করেছেন। এ কাজে তাদের মাধ্যম ছিলেন নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগসহ বেশ কয়েকজন নৃত্যসংগঠক এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আরও কিছু ‘এজেন্ট’।

এদিকে বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে নারী পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ার সোহাগকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি (ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগ) কর্মকর্তারা। ‘ধ্যাততেরিকি’ সিনেমায় নৃত্য পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সোহাগ। করপোরেট অনুষ্ঠানে নাচার জন্য সোহাগ ড্যান্স ট্রুপ নামে তার একটি দল আছে। এছাড়া ‘নৃত্যভূমি’ নামে আরও একটি নাচের দল রয়েছে তার।

পুলিশ জানিয়েছে, দেশ থেকে নারী সংগ্রহ করে পাঠানোর পাশাপাশি সোহাগ তার নাচের দল নিয়ে দুবাইয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন প্রায়ই। ফেরার সময় সেই দল কয়েকজন করে মেয়েকে রেখে আসতেন কৌশলে।

এদিকে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সেলিম নামের আরও একজনের মাধ্যমে আজম খান ও তার দুই ভাই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী সংগ্রহ করতেন। চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেট থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে নারী সংগ্রহের কাজটি বিশেষ করে আজম খানের পক্ষে তদারকি করতেন সেলিমই। সংগ্রহ করা নারীদের পাসপোর্ট তৈরি করে বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও তারই ছিল। দুবাই থেকে এসব নারীর ভিসাসহ যাবতীয় কাগজপত্র দেশে সেলিমের কাছেই পৌঁছাতেন আজম খান।

বিদেশে নারী পাচারের ঘটনায় গত ২ জুলাই লালবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছে। এতে পাচারকারী আজম খান, তার দুই ভাই নাজিম উদ্দিন ও এরশাদ ছাড়াও আল আমিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ড, মো. স্বপন হোসেন, নির্মল দাস (এজেন্ট), আলমগীর (দুবাই ক্লাবের সুপারভাইজার), আমান (এজেন্ট) ও শুভকে (এজেন্ট) আসামি করা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!