দেশে ফেসবুকে কেনাকাটা জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন, ঈদে বেচাকেনার ধুম

দুই বছরে ২০ গুণ বেড়েছে অনলাইনের কেনাকাটা

মহামারী করোনা দিন দিন নতুন রূপ নিচ্ছে। যার ফলে লকডাউনের দিনও বাড়ছে পালাক্রমে। সংক্রমণ রোধে ঘরবন্দি মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছে অধিকাংশ মানুষ।

ঈদকে সামনে রেখে কেনাকাটায় অনলাইন এখন নির্ভরযোগ্য স্থান। গত ২ বছরে যার বেচাকেনার আকার ১৫-২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপগুলো। সেই সাথে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছে এইসব গ্রুপ।

বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষের আস্থা সবচেয়ে বেশি ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপগুলোর ওপর। যার ফলে দিন দিন ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ থেকে পণ্য কেনাকাটায়।

এর মধ্যে রয়েছে অনলাইন প্লাটফর্মের সবচেয়ে বড় গ্রুপ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই), চট্টগ্রাম ই-কমার্স ফ্যামিলি (সেফ), বেস্ট ই-কমার্স প্লাটফর্ম (বিইসিপি), ইজি শপিং চট্টগ্রাম, এমএন্ডএম বিজনেস করপোরেশন, এক্টিভ ই-কমার্স ফোরাম, এমইএফ ইত্যাদি।

ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে— বাই & সেল, অপরাজিতা, গার্লস প্রায়োরিটি, উদ্যোক্তা, জাগো, উদ্যােক্তা হতে চাই, লেডিস ই-কমার্স ফোরাম, যুব নারী উন্নয়ন সংস্থা, উদ্যোক্তা স্কুল, ই-উদ্যোক্তা ইত্যাদি।

এই বিষয়ে অনলাইন প্লাটফর্মের সবচেয়ে বড় গ্রুপ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত বছর থেকে করোনার কারণে সবাই খুবই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। হতাশা কিন্তু করোনার চেয়েও খারাপ জিনিস। সেই হতাশা থেকে বের করার জন্য আমরা চিন্তা করলাম অনলাইনে এক্টিভিটিগুলো ধরে রাখি। তাহলে কিছুটা হলেও হতাশা দূর করার সম্ভব। সেজন্য উই থেকে স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে অনেক কাজ করে এবং সেখান থেকে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময়ই চেষ্টা করছি কেউ যাতে অলস বসে না থাকে। কারণ মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আমরা উদ্যোক্তা তৈরি করছি দেশি ও বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে আমরা বিভিন্ন ধরনের অনুদানের ব্যবস্থা করেছি উই’র পক্ষ থেকে। যাতে একজন উদ্যোক্তার স্বপ্ন মাঝপথে থেমে না যায়।’

জানা গেছে, উই’র পক্ষ থেকে রমজানে ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা হয়। সেখানে দেশি-বিদেশি ক্রেতা সরাসরি পণ্য ক্রয় করার সুযোগ পেয়েছেন। সেই সাথে উদ্যােক্তাদের নতুন নতুন জিনিস শিখানোও হয়। জুমের মাধ্যমে সেই ফেস্টিভ্যালে দেশীয় পণ্যের জন্য ২৫ জন বিদেশী বায়ার, ২৫০ জন্য উদ্যােক্তা পণ্য প্রদর্শনীর সুযোগ পায়। টেক্সটাইলেও ২৫ জন বিদেশি বায়ার ও ২০০ জন্য উদ্যােক্তা পণ্য প্রদর্শনী করে।

বর্ডার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ফেস্টিভ্যালের সব অর্ডার উদ্যােক্তারা ডেলিভারি করতে পারেনি। যতটুকু অর্ডার ক্লিয়ার হয়েছে তাও ৩ কোটি টাকার বেশি। বাকি অর্ডারগুলো যত দ্রুত সম্ভব ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছেন তারা। ৩০ মার্চ থেকে প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা করে ৫ দিনের ফেস্টিভ্যালে আয়োজন করা হয়। সেখানে কয়েক কোটি টাকা সেল করেছে উদ্যেক্তারা। এখন পর্যন্ত সেই প্রক্রিয়া চলমান আছে।

এই নিয়ে চট্টগ্রাম ই-কমার্স ফ্যামিলির (সেফ) কর্ণধার সাগর দে বলেন, ‘গত বছর থেকে করোনার কারণে অনলাইনে কেনাকাটা প্রায় ১৫-২০ গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। রমজানে সেই সেল আরও বেশি বেড়েছে। সেফ থেকে গত মাসে ৫ দিনের ফেস্টিভ্যালে ১ হাজার অর্ডার ডেলিভারি দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি শুক্রবার ফ্রাই ডে ফান্ডা আয়োজন করে সেফ। সেখানে ৮০০ এর বেশি অর্ডার আসে। বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল বা ফ্রাই ডে ফান্ডায় উদ্যোক্তারা ১০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ক্রেতারা কেনাকাটা বেশি করছে। যেটা অনলাইন বিজনেস জন্য প্লাস পয়েন্ট।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্রেতাবান্ধব উদ্যোক্তা তৈরি করা। সেফ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। এইবছরের মধ্যে সেফের নামে ওয়েবসাইট চালু হতে পারে। সেখানে সব উদ্যোক্তারা তাদের প্রডাক্টটা অটোমেটিক দেখাতে পারবে। সেফে যত মেম্বার আছে তাদের আইনগত সত্ত্বা দিতে পারি এটা নিয়েও আমরা কাজ করছি। অনলাইন থেকে বিক্রেতা যাতে কোন পণ্য কিনে হয়রানি বা ধোঁকার শিখার না হয়, সেজন্য ক্রেতাদের সব সময়ই সর্তক করা হয় সেফ থেকে। কোনো কারণবশত ক্রেতা পণ্য নিয়ে অভিযোগ আসলে বিক্রেতাকে ভুল শোধরানো সুযোগ দেওয়া হয়। বিক্রেতারা সেটা না পারলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। যার জন্য অনলাইন বিজনেস এখন ভরসার স্থান অর্জন করেছে।’

বেস্ট ই-কমার্স প্লাটফর্মের (বিইসিপি) এডমিন তানিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ছোট গ্রুপ। আমরা চেষ্টা করছি ক্রেতা ও বিক্রেতাকে কেনাকাটার একটা উপযুক্ত পরিবেশ দিতে। এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রুপ নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কারও কাছে কোন অভিযোগ পাইনি। উদ্যোক্তাদের বিক্রি বৃদ্ধিসহ নানান সুযোগ সুবিধা গ্রুপ থেকে দিচ্ছি। রমজান উপলক্ষে প্রতি বৃহস্পতিবার ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে ১০-৫০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সাথে গ্রুপের পক্ষ থেকে সেরা ক্রেতা, সেরা বিক্রেতা ও রিভিউ দাতার জন্য পুরষ্কারের আয়োজন করা হয়েছে। উদ্যোক্তা ও ক্রেতারা সেই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন। এর মধ্যেই গ্রুপ থেকে ১ লাখ টাকার উপরে সেল করছেন উদ্যােক্তারা। ছোট গ্রুপ হিসেবে আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।’

তিনি বলেন, ‘বিইসিপি সব সময়ই চেষ্টা করছে নতুন কিছু উদ্যােগ নিয়ে উদ্যােক্তাদের পথ আরো সম্প্রসারিত করা। পুরা রমজান মাস ধরে আমরা সেটাই চেষ্টা করেছি যাতে সেল বেশি হয়। সেল বৃদ্ধির জন্য ঈদের পরেও নতুন পরিকল্পনা নিয়ে উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহযোগিতা করবো আমরা। এখন অনলাইন যুগ সবাই অনলাইনে কমবেশি কেনাকাটা করছে। সময়টাকে বাঁচানোর জন্য সবাই এই প্লাটফর্মের উপর বিশ্বাস করছে এটা অনলাইন বিজনেসের জন্য ভালো দিক।’

অনলাইন বিক্রেতা ফুড বক্সবিডি’র কর্ণধার আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা যারা অনলাইন বিজনেস করছি তাদের প্রায় সকলেই ইয়াং জেনারেশন। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশের ইয়াং জেনারেশন তার সঠিক ব্যবহার করে ই-কমার্স বা এফ কমার্স বলেন অনেক দূর এগিয়েছে। অনলাইন বিজনেস তার মধ্যে অন্যতম। আমরা পণ্যের গুণগত মান ঠিক রেখে পণ্যটি সঠিক মূল্যে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। যার জন্য অনলাইন এখন একটি বিশ্বস্ত প্লাটফর্ম। বিগত দিনের তুলনায় অনলাইন কেনাকাটার প্রবণতা গত দুইবছর ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে করোনার কারণে। করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের লকডাউন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ রোধে মানুষ ঘরে বসেই কেনাকাটা করছে। পণ্য কেনাকাটায় এখন নির্ভরযোগ্য স্থান অনলাইন। আমাদের ফুড বক্স বিডি লাস্ট ৩ মাসে ৫০০ এর অধিক অর্ডার সম্পূর্ণ করে আয় হয়েছে ৭ লাখের অধিক টাকা। আমাদের মত অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে।’

অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত ফাহিমা আক্তার মাহি বলেন, ‘করোনার মধ্যে ঘরবন্দি জীবন। পরিবারের কথা চিন্তা করে ঘরে বাইরে তেমন যাওয়া হয় না। কিন্তু কেনাকাটা তো করতে হয়, তাই একমাত্র ভরসা এখন অনলাইন। ঘরে বসে অর্ডার করে দিচ্ছি মুহুর্তের মধ্যে পণ্যটি হাতে পেয়ে যাচ্ছি। বর্তমান বিশ্ব অনলাইনে অনেক দূর এগিয়েছে আমরা কেন পিছনে পড়ে থাকব। কিছু ধোঁকা বাজ ব্যবসায়ীর জন্য আমরা অনলাইন বিজনেসকে বিশ্বাস করতাম না কিন্তু এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। সেজন্য এখন সব কেনাকাটা অনলাইনেই করি।’

এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!