চট্টগ্রামে প্রায় দেড় বছর ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা একটি জমি সংক্রান্ত মামলা হঠাৎ সচল করে সেখানে একজন সাংবাদিকের নাম আসামি হিসেবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালী একটি চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করায় এবং নতুন অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে চট্টগ্রামের সাংবাদিক জিয়াউল হক ইমনকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। পুরো ঘটনাটি চট্টগ্রামের বিচারপ্রক্রিয়া, পুলিশের ভূমিকা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। এ ঘটনায় ভূমির ব্যবসায় জড়িত পুলিশের কিছু সদস্যও ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।
যেখান থেকে বিতর্কের শুরু
২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক জিয়াউল হক ইমন দৈনিক দেশ বর্তমানে ‘কাল্পনিক মামলায় হয়রানি বাড়ছে চট্টগ্রাম আদালতে: জালিয়াতিতে জড়িত আইনজীবীদের একটি চক্র’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি আদালতের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্রের জালিয়াতি ও সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার চিত্র তুলে ধরেন। যদিও সেই প্রতিবেদনে বর্তমান মামলার বাদী নুরুল ইসলাম বা আলিমুল এহছান রাসেলের নাম উল্লেখ ছিল না, কিন্তু এর প্রায় এক বছর পর তাদের দায়ের করা একটি পুরনো মামলায় ইমনকে বিস্ময়করভাবে ২ নম্বর আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দেড় বছরের পুরনো মামলা হঠাৎ সচল
২০২৪ সালের ৫ জুন নুরুল ইসলাম ও আলিমুল এহছান রাসেল বাদী হয়ে আলাউদ্দিন নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলা দায়েরের পর দেড় বছর ধরে এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি ছিল না। আদালত একাধিকবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেও পুলিশ বা বাদী পক্ষ—কেউই তাতে কান দেয়নি। রহস্যজনকভাবে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মামলাটি আবার সক্রিয় হয় এবং সাংবাদিক ইমনসহ আরও দুজনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আরেকটি বড় অসঙ্গতি হলো মামলার এখতিয়ার নিয়ে। ঘটনার কেন্দ্রস্থল চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী বা বায়েজিদ থানা এলাকায় হলেও তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে ডবলমুরিং থানাকে। প্রধান আসামি আলাউদ্দিনের অভিযোগ, তৎকালীন ডবলমুরিং থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজের নির্দেশে ঘটনাস্থল ডবলমুরিং দেখানো হয়, যাতে তাকে এবং অন্য বিবাদীদের জড়িয়ে আদালতে মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করা সহজ হয়।
জমির মালিকানা স্পষ্ট, তবু প্রতারণার অভিযোগ
মামলার প্রধান আসামি আলাউদ্দিনের দাবি, তিনি জমির প্রকৃত মালিক। তার দাবির সপক্ষে তিনি অনলাইন খাজনার রশিদ, নামজারি, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন এবং তিনজন সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এই কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জমিটি আলাউদ্দিনের ভোগদখলেই রয়েছে। এমনকি একই জমি নিয়ে করা আগের একটি মামলা (নং-২০৬/২০২১) আদালত খারিজ করে দিয়েছেন, যা আলাউদ্দিনের মালিকানার দাবিকে আরও শক্তিশালী করে।
অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ ও অস্পষ্টতা
বাদীপক্ষের মূল অভিযোগ, আলাউদ্দিন প্রতারণা করে জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছেন এবং চেক ডিজঅনার করেছেন। তবে এই অভিযোগগুলো নিয়েও নানা অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন মামলার অভিযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ব্যাংকার আব্দুর রশিদ ও ব্যবসায়ী কফিল উদ্দিনের নাম উল্লেখ থাকলেও তারা দুজনেই বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আমি বাদীদের চিনি না এবং আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’ কফিল উদ্দিনও জানান, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
বাদীপক্ষের অভিযোগ, চেক প্রতারণা করা হয়েছে। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, চেক হস্তান্তর করা হয়েছিল পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ তোফায়েল আজমের মধ্যস্থতায় সাক্ষীদের উপস্থিতিতে। বিবাদীপক্ষ দাবি করে, চুক্তি ভঙ্গের পরও প্রতিপক্ষ তাদের অঙ্গীকার পূরণ করেনি, তাই চেক কার্যকর হয়নি।
এছাড়া বাদীপক্ষ ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ আনলেও আদালতে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। উল্টো বিবাদীপক্ষের দাবি, ওই ভিডিওতে তাদের হুমকি দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
মামলার বাদী নুরুল ইসলাম দাবি করেছেন, মামলাটির মূল পরিকল্পনাকারী রাসেল। তিনি বলেন, ‘আমি তেমন কিছু জানি না। আমার নাম শুধু দেওয়া হয়েছে।’
‘মূল পরিকল্পনাকারী’ রাসেল সাংবাদিকের নাম মামলায় ঢুকিয়ে ‘ভুল কিছু করিনি’ বলে দাবি করেন। হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন মামলা সামনে আরও আসবে।’
‘চুক্তির ফাঁদে’ পুলিশি হয়রানির অভিযোগ
আলাউদ্দিন অভিযোগ করেন, ‘আমি লেখাপড়া জানি না। সেই সুযোগ নিয়ে ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি আমাকে দিয়ে নামমাত্র মূল্যে একটি অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। পুলিশের নির্দেশে এক বছর পর্যন্ত আমাকে সেই দলিলের কোনো অনুলিপি দেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বিস্ফোরক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমমোক্তারনামাটি আমারসহ তিনজনের নামে থাকলেও আমাকে না জানিয়ে মামলার বাদী আলিমুল এহছান রাসেল ও নুরুল ইসলাম জমির বেশিরভাগ শেয়ার পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের কাছে বিক্রি করে দেন। এই চক্রের পেছনে এসআই জহিরুল ইসলামসহ তৎকালীন পুলিশের একটি অসৎ চক্র জড়িত ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা ১ কোটি ২১ লাখ টাকার ব্যয় দেখিয়ে ঘুষের হিসাব যুক্ত করেছে, যার মধ্যে পুলিশের কাছে ২২ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া দেখানো হয়েছে। এসব নিয়ে আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছি। তবু প্রতিকার পাইনি।’
তার অভিযোগ, তৎকালীন সিএমপি বায়েজিদ জোনের এসি বেলায়েত হোসেন এবং উত্তর বিভাগের একজন এডিসিও তাকে ন্যায়বিচার দেওয়ার বদলে প্রতিপক্ষকে সহযোগিতা করেন। আলাউদ্দিন বলেন, ‘শুধু এই গোপন মামলা নয়, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী থানায় আগেও আমার নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা হয়েছে। এখন ঘটনাস্থল ইচ্ছাকৃতভাবে ডবলমুরিং দেখিয়ে আমাকে ও সাংবাদিক ইমনকে জড়ানো হচ্ছে। আমি এসব নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকারের অপেক্ষায় আছি।’
বক্তব্য ও ভাষ্য
সাংবাদিক জিয়াউল হক ইমন বলেন, ‘সম্প্রতি আমি এক প্রভাবশালী আইনজীবী ও ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নতুন অনুসন্ধান শুরু করি। বিষয়টি জানতে পেরেই তারা দেড় বছরের পুরনো এই ‘গোপন’ মামলাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। এটি শুধু আমার নয়, পুরো সাংবাদিক সমাজের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ।’
এ বিষয়ে সিএমপি পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার হোসাইন মোহাম্মদ কবির ভূঁইয়া জানান, ‘মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা যথাযথ অনুসন্ধান করে দ্রুত আদালতে প্রতিবেদন জমা দেব।’



