দুজনের হাতে বন্দি চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পদে পদে দুর্নীতি ও অনিয়ম

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একের পর এক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও এখনও বহাল রয়ে গেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চমেবি) ‍উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান। অভিজ্ঞতা ছাড়া সরাসরি পঞ্চম গ্রেডে নিয়োগ পাওয়া উপ-পরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়ার বিরুদ্ধেও শুরু থেকেই আছে ব্যাপক অভিযোগ। ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে যথারীতি বহাল আছেন তিনিও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুজনের হাতে পুরো চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন বন্দি। অনিয়মই সেখানে হয়ে ওঠেছে নিয়ম। সরকার পরিবর্তন হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এলেও এখনও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুর্নীতি ও অনিয়মের লাগাম টানা তো দূরের, বরং দিন দিন সেটা বাড়ছেই।

দুজনের হাতে বন্দি চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পদে পদে দুর্নীতি ও অনিয়ম 1

উপাচার্য ইসমাইল খানের যতো কীর্তি

আওয়ামী লীগ সরকার উপাচার্য ইসমাইল খানকে ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল তাকে আরও চার বছরের জন্য একই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ছাত্রজীবনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ইসমাইল খান স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থনে গঠিত ‘জনতার মঞ্চের’ সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার তাকে একদফা চাকরিচ্যূত করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি চাকরি ফিরে পান।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, উপাচার্য ইসমাইল খান একের পর এক অনিয়ম করে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ডই প্রায় ভেঙে দিয়েছেন।

২০২৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে ১ হাজার ৮৫১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়। এই প্রকল্প অনুমোদনের সাত মাসের মাথায় উপাচার্য ইসমাইল খান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আসেন। ওই সময়ও সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন রাখেন— ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কাজের দায়িত্ব কিভাবে একজন ডাক্তার পেতে পারেন?

২০২৩ সালের ২৩ মে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়ম নিয়ে একটি পরিপত্র প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সেখানে উপাচার্যের বেতন বৃদ্ধিসহ সাতটি খাতে আর্থিক অনিয়ম পাওয়ার তথ্য প্রকাশ করে ইউজিসির পর্যবেক্ষক দল।

ইউজিসির পর্যবেক্ষক দলের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‍নিয়োগ অনুযায়ী উপাচার্য ইসমাইল খানের বেতন স্কেল তৃতীয় গ্রেডের হলেও তিনি নিয়মের ধার না ধেরেই বেতন নিয়ে আসছেন প্রথম গ্রেডের। আবার সিন্ডিকেট থেকে বেতন বৃদ্ধির বিষয়টিও পাস করিয়ে নেন। তৃতীয় স্কেলে ৭৪ হাজার টাকা মূল বেতন হলেও প্রতি মাসে তিনি নিয়ে আসছেন ভাতাসহ প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা।

ইউজিসির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্য সর্বশেষ প্রতিষ্ঠান থেকে আহরিত বেতন-ভাতাদির সমপরিমাণ অর্থ মাসিক বেতন হিসেবে প্রাপ্য হবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নিয়ম পরিবর্তন করে তার বেতন প্রথম গ্রেডে উন্নীত করে। অথচ ওই এখতিয়ার সিন্ডিকেটের নেই।

নিজের বেতনেই শুধু নয়, আজ্ঞাবহ কর্মচারীদের বেতন নিয়েও উপাচার্য ইসমাইল খান বড় ধরনের অনিয়ম করেছেন। অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ছয় কর্মচারীকে নিয়মবহির্ভূতভাবে উচ্চতর স্কেলে বেতন দেওয়া নিয়ে ইউজিসির পর্যবেক্ষণেও বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। ইউজিসির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তরা চাকরি যেহেতু অস্থায়ী, সেহেতু উচ্চতর স্কেলে তাদের বেতন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

জানা গেছে, উপাচার্য ইসমাইল খান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটকে না জানিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মো. আলাউদ্দিন, মো. মিছবাহ ইবনে হাকিম, কাজী মুসফিকুস সালেহীন, মো. আব্দুল্লাহ আল নোমান, বদিউল আলম ও মুহাম্মদ আনিক আল হোসাইনকে নিয়োগ দেন। এতে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, ছলতাচাতুরিসহ নানা অসঙ্গতি পায় ইউজিসির তদন্ত দল।

তদন্তে উঠে এসেছে, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে উন্মুক্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। এটিকে দেশের সংবিধান পরিপন্থী এবং নাগরিকের অধিকার হরণ বলে উল্লেখ করেছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি। এছাড়াও ওই নিয়োগে মানা হয়নি চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইনের নির্দেশনাও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে ইউজিসির অনুমোদিত শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি নিয়োগে আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন পরিলক্ষিত হয়েছে।

শুধু তাই নয়, ইসমাইল খান তার নিজের চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব তহবিল থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন। ইউজিসি এটাকেও অনিয়ম বলে মতপ্রকাশ করেছে প্রতিবেদনে।

চট্টগ্রামে অফিস না করেও ঢাকায় বসে বিভিন্ন মিটিংয়ের সম্মানী ও বেতন-ভাতা গ্রহণের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া মেডিকেল ও নার্সিং কলেজের ভর্তি বাণিজ্যেও তার যুক্ত থাকার কথা শোনা যায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা প্রায় ৪০টি বেসরকারি মেডিকেল ও নার্সিং কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত থাকলেও উপাচার্য ইসমাইল খান নিজে তো সম্মানী নেনই, এমনকি তার গাড়িচালককেও সম্মানী দিতে হয় বলে কলেজের পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিভিন্ন সময় জানা গেছে।

ভাইয়ের জোর বিদ্যুৎ বড়ুয়ার

অভিজ্ঞতা ছাড়াই উপ-পরিচালক হিসেবে সরাসরি পঞ্চম গ্রেডে নিয়োগ পাওয়া বিদ্যুৎ বড়ুয়ার বিরুদ্ধেও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকেই। তার বড় ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার প্রভাবে এই নিয়োগ পান বিদ্যুৎ বড়ুয়া— এমন অভিযোগ রয়েছে। এই প্রভাব খাটিয়ে উপ-পরিচালক হয়েও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ‘ক্ষমতা’ যেন উপাচার্যের চেয়েও বেশি। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড থেকে আর্থিক বিষয়াদি, যানবাহন, রেস্টহাউজ ও গেস্ট হাউস সবকিছুই তার একক নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার ও কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণও শুরু থেকেই তার হাতে। আবার টাকার বিনিময়ে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে বিদ্যুতের বিরুদ্ধে। এর বেশকিছু প্রমাণ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে সংরক্ষিত রয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের অনিয়মকেই যেন নিয়মে পরিণত করেছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। কোনো কমিটির সদস্য না হওয়ার পরও প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং কলেজের সভা থেকে তিনি ভাতা গ্রহণ করেন নিয়মিত। এ নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যেও ক্ষোভ আছে। এমনকি শুধু প্রকল্প ছড়ি ঘোরানোর লোভে ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের দায়িত্বও তিনি নিজের ঘাড়ে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি।

জানা গেছে, পাহাড়তলীর রোজভ্যালি আবাসিক এলাকায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজটিও রয়েছে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার দখলে। ওই গেস্ট হাউজটির মালিক আবার উপাচার্য ইসমাইল খানের ভাই আজম খান। বেশি ভাড়া দেখিয়ে ভাইয়ের ফ্ল্যাট গেস্ট হাউজ হিসেবে ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

এতো কিছুর পর আবার চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২২-২০২৩ সালের শুদ্ধাচার পুরস্কারটিও উপ-পরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া নিজের করে নিয়েছিলেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm