দুই রিপোর্ট লুকিয়ে নতুন ‘সাফাই’, রাঙামাটির নারী পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে আবার
নাম বদল চারবার, ধর্ম বদল চারবার, বিয়েই শুধু পাঁচবার
নিজের নাম বদল করেছেন চারবার, বিয়ে করেছেন পাঁচবার আর ধর্ম বদলেছেন চারবার। আছে শৃঙ্খলাভঙ্গের একাধিক অভিযোগও। দুই দফা তদন্তে রাঙামাটি কোর্টের সাবেক মহিলা উপপরিদর্শক (এসআই) হ্যামি প্রু মারমার বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতাও মেলে। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ ওঠে। কিন্তু রাঙামাটি পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে উর্ধতন দুই পুলিশ কর্মকর্তার দুটি তদন্ত প্রতিবেদনই গোপন করে ঢাকা পুলিশ সদরদপ্তরে উল্টো রিপোর্ট পাঠানো হয়— বিভাগীয় মামলার তদন্তে হ্যামি প্রু মারমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সেই রিপোর্টের অস্বাভাবিকতা নজর এড়ায়নি পুলিশ সদরদপ্তরের ডিসিপ্লিন শাখার। এরপরই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়া ওই মহিলা এসআইয়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভাগীয় মামলা তৎক্ষণাৎ পুনঃতদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রাঙামাটির আলোচিত এই এসআই হ্যামি প্রু মারমা বর্তমানে ফেনী জেলা কোর্টে নারী ও শিশু ডেস্কে সিএসআই হিসাবে কর্মরত আছেন। বান্দরবানের বালাঘাটার এই স্থায়ী বাসিন্দা ১৯৯৯ সালের ২৩ আগস্ট কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। নামটি সারল্যে ভরা পাহাড়ি নারীর নাম হলেও কর্মকাণ্ড সেভাবে সরল নয় পুলিশের এই নারী এসআইয়ের। ধর্ম ও নাম পরিবর্তন করে তিনি বারবার বিয়ে করেন। আবার সব স্বামীর বিরুদ্ধেই মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে তাদের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। অভিযোগ উঠেছে, প্রাক্তন সব স্বামীর কাছ থেকেই তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। সর্বশেষ চতুর্থ স্বামী থুই হলা প্রু মারমাকে ডিভোর্স দেওয়ার পর তার পঞ্চম স্বামী এখন নোমান চৌধুরী বাদল নামের এক ব্যক্তি। নিজ অফিসেও উর্ধ্বতন বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মিথ্যা অভিযোগ এনে তাদের নাজেহাল করেছেন হ্যামি— মিলেছে এমন অভিযোগও।
জানা গেছে, চলমান বিভাগীয় মামলার আগেও পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নিয়মবর্হিভূত কাজ, গাফিলতি ও অবহেলা করায় ২০১২ ও ২০২০ সালে দুইবার শাস্তি হিসেবে ‘তিরস্কৃত’ হন হ্যামি। চাকরিতে যোগ দেওয়ার এক মাসের মাথায় ১৯৯৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পুলিশ একাডেমি সারদার উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনায় তাকে সতর্কও করা হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৯ সালেও রাঙামাটি সদর কোর্টের এক পুলিশ পরিদর্শকের বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ আনেন হ্যামি। ওই অভিযোগ এখনও বিভাগীয় তদন্তের অধীনে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি কোর্টে কর্মরত থাকাকালে মহিলা এসআই হ্যামি প্রু মারমা ওরফে খাতিজা আকতারের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তের জন্য দুই দফায় দায়িত্ব পান চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশ কার্যালয়ের তৎকালীন এডিশনাল এসপি সারোয়ার জাহান এবং খাগড়াছড়ি জেলার এডিশনাল এসপি মেহেদী হাসান। দুজনেই তাদের তদন্তে হ্যামি প্রু মারমার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পান। এরপর চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেনের পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনেও মেলে অভিযোগের সত্যতা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, রাঙামাটি জেলার বিদায়ী পুলিশ সুপার মীর মোদ্দাছ্ছের হোসেন এই দুই প্রতিবেদনের কথাই গোপন রেখে হ্যামি প্রু মারমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলায় ওঠা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি মর্মে উল্টো প্রতিবেদন পাঠান ঢাকা পুলিশ সদরদপ্তরে। দুই প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা মেলার পরও সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার মীর মোদ্দাছ্ছের হ্যামিকে ‘ভালো মেয়ে’ দাবি করে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার ওরফে হ্যামি প্রু মারমা ষড়যন্ত্রের শিকার।’ তারও আগে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার পরই রাঙামাটি জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তার বিশেষ তদবিরে হ্যামি প্রু মারমাকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কৌশল হিসেবে আলাদা একটা ফরওয়ার্ডিংসহ ফেনী জেলায় কোর্টে পদায়ন করা হয় বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদন গোপনের এই ঘটনায় ভূমিকা রাখেন সম্প্রতি তিন কনস্টেবলকে বলাৎকারের ঘটনায় অভিযুক্ত রাঙামাটি জেলা পুলিশ রিজার্ভ অফিসের এসআই শওকত আলী ভুঁইয়াও। কিন্তু রাঙামাটির এসপির পাঠানো প্রতিবেদনে অসঙ্গতি ও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে পুলিশ সদরদপ্তরের ডিসিপ্লিন শাখা নড়েচড়ে বসে। এর পরপরই বিভাগীয় মামলাটি আবার তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। আর এর তদন্তভার দেওয়া হয়েছে রাঙামাটি জেলার ডিএসবি শাখার এডিশনাল এসপি অহিদুর রহমানকে।
রাঙামাটি জেলার এডিশনাল এসপি (ডিএসবি) অহিদুর রহমান মামলার বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসআই হ্যামি প্রু মারমা ওরফে সামিয়া হোসেন ওরফে খাতিজা আকতার হ্যামির বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ হেডকোয়াটার্সে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ঢাকা থেকে পুনঃতদন্তের নির্দেশ আসার বিষয়টি আমি অবগত নই। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে আমার কাছে আসতে পারে।’
তদন্তে দোষী, এসপির কাছে ‘ভালো’
২০১৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের পক্ষ থেকে মহিলা এসআই হ্যামি প্রু মার্মার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর ওই বছরের নভেম্বরে রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সারোয়ার জাহানের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়েছে— হ্যামি প্রু মার্মা নাম পরিবর্তন করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। বারবার ধর্ম ও নাম পরিবর্তন করে এবং একাধিকবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পুলিশের মতো সুশৃঙ্খল বাহিনীর আইনকানুন ও ধর্মীয় বিধিবিধানকে খুবই থোড়াই কেয়ার করার মানসিকতা প্রদর্শন করেছেন। এজন্য কঠোরভাবে সতর্ক করে লিখিত অঙ্গীকারনামা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়।
অন্যদিকে ২০২১ সালের ১৫ মার্চ খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মেহেদী হাসানের তদন্ত প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়েছে— তিনি (হ্যামি প্রু মার্মা) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও একাধিক বিবাহের কারণে জনমনে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। এক্ষেত্রেও হ্যামিকে ‘সতর্ক’ করার সুপারিশ করা হয়।
২০২১ সালের ৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পুলিশ হেডকোয়াটার্সের অ্যাডিশনাল ডিআইজিকে জানানো হয়, ‘পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, এসআই (নিরস্ত্র)/হ্যামি প্রু মার্মা @ মোছাম্মৎ খাদিজা আকতার হ্যামির সাংসারিক জীবন দীর্ঘায়িত না হওয়ার কারণে একাধিক বিবাহে আবদ্ধ হন। তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হওয়া সত্বেও একাধিক বিবাহের কারণে জনমনে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। যেহেতু তিনি বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য, সেহেতু বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কাজ হতে বিরত থাকার জন্য তাকে সতর্ক করা যেতে পারে মর্মে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।’
২০২১ সালের ২০ মে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অ্যাডিশনাল ডিআইজি রেজাউল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে হ্যামি মার্মার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে বিভাগীয় মামলার ফলাফল পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের জানানোরও নির্দেশ দেওয়া হয় ওই চিঠিতে।
শৃঙ্খলাভঙ্গ, অবাধ্যতা, গড় হাজির, বাহিনীর সুনামহানি, অকর্মকর্তাসুলভ আচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে রাঙামাটি জেলার সদর কোর্টে কর্মরত এসআই হ্যামি প্রু মার্মার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা (নম্বর ৪১/২০২১) দায়ের করা হয় ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর।
কিন্তু সেই মামলায় হ্যামি প্রু মার্মার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা মেলেনি— পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে রাঙামাটি জেলার বিদায়ী পুলিশ সুপার মীর মোদ্দাছ্ছের হোসেন এমন রিপোর্ট পাঠানোর পর সেটি আমলে না নিয়ে অভিযোগগুলো আবার পুনঃতদন্তের আদেশ দেওয়া হল।
আরএ/সিপি