ভুলে ভরা দিয়ারা জরিপে চট্টগ্রামে লাখো ভূমি মালিকের সর্বনাশ!

সেটেলমেন্ট কর্মকতা-কর্মচারীদের অবহেলা ও খসড়া তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ না দিয়ে দিয়ারা খতিয়ানে ভুয়া মালিকের নামে সৃজন হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চট্টগ্রামের প্রায় লাখখানেক জমির প্রকৃত মালিক। নতুন এ জরিপ সৃজন করার ফলে দীর্ঘদিনের ভোগদখলীয় জমির খাজনা পরিশোধ, নামজারি সংশোধন ও জমির রেজিস্ট্রি করতে নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে তাদের। এ জটিলতায় ভূমি হারানোর আশংকা করছেন অনেকেই।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি দিয়ারা খতিয়ান সংশোধন করতে ২০-৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ভূমি সার্কেলের লোকজনকে। অন্যথা হলে আদালত মামলার দীর্ঘ জটিলতায় পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক ভূমি মালিক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকে স্থানীয় ভূমি অফিসের কর আদায় ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে জমি বেচা-কেনায় বিএস খতিয়ানের পরিবর্তে নতুন সৃজন করা দিয়ারা খতিয়ানকে বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। স্বাধীনতার আগে ছিল এসএ জরিপ, সিএ জরিপ, আরএস জরিপ, পিএস এবং ১৯৭২ সালে সৃজন হয় বিএস জরিপ। ২০১৯ সালে দিয়ারা জরিপ দিয়ে জমির খাজনা, বেচাকেনা, নামজারিসহ অন্য কাজ করা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

এদিকে চট্টগ্রামের আটটি মৌজায় ইতিমধ্যে দিয়ারা জরিপ সৃজন করা হয়েছে। এর মধ্যে চন্দনাইশ উপজেলার লতিফপুর মৌজা, জাফরাবাদ মৌজা, ভইলতলী মৌজা, নগরের বন্দর থানাধীন দক্ষিণ কাট্টলী মৌজা, উত্তর কাট্টলী মৌজায় ও মধ্যম হালিশহর মৌজায় নতুনভাবে দিয়ারা জরিপ সৃজন করা হয়েছে।

এদিকে একই সমস্যা হয়েছে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার চন্দনাইশ উপজেলার লতিফপুর মৌজা, জাফরাবাদ মৌজা, ভইলতলী মৌজায়। সেখানেও বিএস খতিয়ানে থাকা পৈত্রিক সম্পত্তিতে নাম ও রেকর্ডপত্রে অহরহ ভুল হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার লোক।

চন্দনাইশ উপজেলায় লতিফপুর মৌজায় বজল আহমদ সম্প্রতি জমির খাজনা দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। তিনি বলেন, ৪ বছর আগে জমির খাজনা পরিশোধ করেছি। সম্প্রতি খাজনা দিতে গিয়ে দেখি দিয়ারা জরিপে আমার নাম নেই। বিষয়টি সেটেলমেন্ট অফিস ও তফশিল অফিসে গিয়ে জানতে চাইলে টাকা দিলে সহসা মিলবে সমাধান। অন্যাথায় আদালতে যান।

একই সমস্যা শুরু হয়েছে বন্দর থানার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। এতে প্রায় অর্ধলক্ষ লোকের দিয়ারা জরিপে জমির প্রকৃত মালিকের নাম ও ক্যাটাগরি ভুল এসেছে। স্থানীয়রা জানান, সেটেলমেন্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা ও সরেজমিনে না এসে অফিস থেকে এই তালিকা হয়েছে বলে দাবি করেন। এখানকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এ জরিপের কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০১৩-২০১৮ সালে ৪টি জমি কেনেন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে যার কাছ থেকে জমি কেনেছি তার নামও নেই আমার নাম নেই। এছাড়া আমার পৈত্রিক একটি পুকুরকে নাল জমি দেখিয়ে সৃজন করে দিয়ারা জরিপে।’

তিনি আরও বলেন, দিয়ারা জরিপে ভুল সংশোধনের ব্যাপারে পতেঙ্গা ভূমি সার্কেল অফিসে এক লোক প্রতিটি জমির নাম সংশোধন করতে ঘুষ দাবি করে ২০-৩০ হাজার টাকা। টাকা দিলে সহসা কাজ হবে। অন্যথায় দীর্ঘ সময়ে সমাধানের পথ মিলবে না বলে বলা হয় সেখান থেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর শফিউল আলম বলেন, ভুলে ভরা দিয়ারা জরিপ সৃজনের ফাঁদে ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে অর্ধলক্ষ বাসিন্দা। গত ১৮ অক্টোবর এবিষয়ে আমার কার্যালয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে মতবিনিময় করা হয়।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, এটি প্রকাশের আগে জনগণকে হালনাগাদের খসড়া কপি যাচাই-বাছা্ইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে করা নতুন এ জরিপ সৃজনে প্রকৃত জমির মালিকদের নামে নেই তাদের জমি। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশেনের মেয়র মহোদয় ও জেলা প্রশাসককে এই কার্যক্রম বন্ধ রাখতে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। প্রয়োজনে আইনি মোকাবেলা করা হবে।

জানতে চাইলে দিয়ারা সেটেলমেন্ট অফিসের চার্জ অফিসার মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘সম্প্রতি দিয়ারা খতিয়ানে যাদের নাম ও ঠিকানা ভুল অথবা জমির পরিমাণ কম বেশি আসছে দিয়ারা জরিপে। তাদেরকে তো এ জরিপ করার সময় দেওয়া হয়েছিল। তখন তো তারা অবহেলা করে সংশোধনের জন্য আসেনি।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক অফিস, তফশিল অফিস ও সংশ্লিষ্ট ভূমি সার্কেল অফিসে দিয়ারা জরিপের কপি পাঠানো হয়েছে। এখন আর কিছু করার নেই। যাদের সমস্যা রয়েছে আদালতের মাধ্যমে এটি সংশোধন করতে হবে। এখন আর কোন পথ নেই।

বিষয়টি নিশ্চিত করে পতেঙ্গা ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার এহসান মুরাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, দিয়ারা জরিপ সৃজন নিয়ে প্রতিদিন অহরহ অভিযোগ জমা পড়ছে। যেগুলো সমাধান করার মতো, সেগুলো তদন্ত করে সমাধান করা হচ্ছে। আর যেগুলো একটি জটিল পর্যায়ে সেগুলো মিস মামলার ও আদালতে মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। একদিনে তো আর সমাধান সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে এটি সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভুল সংশোধন করতে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দিয়ারা জরিপ সৃজন নিয়ে আমার অফিসের কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারী টাকা চাইলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!