দিনে আত্মসমর্পণ, রাতে ক্রসফায়ারের গল্প খুলশী থানা পুলিশের
চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানায় এসে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক পথে আসতে চেয়েছিলেন ১৩ মামলার এক আসামি। বেলাল (৪৩) নামের ওই আসামিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে পরবর্তীতে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পুলিশও।
কিন্তু বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে খুলশী থানায় এসে আত্মসমর্পণ করা বেলালকে গভীর রাতে কথিত অস্ত্র উদ্ধারে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে বন্দুকযুদ্ধে তিনি মারা গেছেন।
এমনিতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে আসামি নিহতের ঘটনা নিয়ে মানবধিকার সংগঠনগুলোর চরম আপত্তি রয়েছে। রয়েছে আদালতের পর্যবেক্ষণও। এরই মাঝে দিনে আত্মসমর্পণকারী এক আসামিকে রাতের বেলায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের গল্প সাজিয়ে মেরে ফেললো খুলশী থানা পুলিশ।
নিহত বেলাল কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার মোহনপুর এলাকার আব্দুল কাদেরের ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম নগরের আমবাগান রেলওয়ে লোকোশেড কলোনিতে বসবাস করতেন। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগে মোট ১৩টি মামলা রয়েছে বলে জানান খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী।
ওসি প্রণব বলেন, ‘বেলাল দিনে আত্মসমর্পণ করলে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি জালালাবাদ পাহাড়ের গোপন আস্তানায় অস্ত্র মজুদ রাখার কথা জানান। রাত দেড়টার দিকে তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে সেখানে তার সহযোগীরা আমাদের আক্রমণ করে। এসময় প্রতিরোধ করলে বেলাল ও এসআই মাহবুুব অপু সহ তিন পুলিশ গুলিবিদ্ধ হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বেলালকে মৃত ঘোষণা করেন। আর মাহবুব অপু ও দুই পুলিশ কনেস্টেবলকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেন। এসময় একটি এলজি, তিনটি রাম দা ও চার রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয় ঘটনাস্থল থেকে।’
তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক আব্দুল হামিদ বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ বেলালকে বৃহস্পতিবার ভোর ছয়টার দিকে হাসপাতালে আনেন খুলশী থানা পুলিশের একটি টিম। জরুরী বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক বেলালকে তখনই মৃত ঘোষণা করেন।’ শরীরের কোন কোন জায়গায় গুলি লেগেছে তা বলতে রাজি হননি তিনি।
যদিও বুধবার ওসি প্রণব চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বেলাল পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগে মোট ১৩টি মামলা রয়েছে। ১১টি মামলায় জামিনে ছিল। দুইটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল বেলালের বিরুদ্ধে। যে দুইটি মামলায় বেলালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে ওই মামলাগুলোতে বেলালকে গ্রেফতার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হবে। বেলাল স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। আমরা তাকে আইন অনুযায়ী সহযোগিতা করবো।’
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কমপক্ষে ২০৪ জন নিহত হয়েছে এবং প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই বাহিনীগুলো আত্মরক্ষায় গুলি চালানোর একই কথা বলে আসছে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করলেও পুলিশ তাদের কোনও মামলা করতে দেয়া হয়নি। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনও তদন্ত হয় কিনা সেই প্রশ্ন করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
এছাড়াও সম্প্রতি একটি আবেদনের শুনানি শেষে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে উচ্চ আদালত বলেছেন, ‘বিচার-বহির্ভূত যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়, সেগুলো আমরা পছন্দ করি না, সমর্থন করি না। আইনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আত্মরক্ষায় গুলি করার যে সুযোগ দেয়া আছে, তার যেন অপপ্রয়োগ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এই আত্মরক্ষার বিষয় সামনে রেখে যাতে কেউ অযাচিত বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড না ঘটানো না হয় সেব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।’
এডি