ত্রাণ পৌঁছেনি সাতকানিয়া-চন্দনাইশে, এমন দুঃসময়ে জনপ্রতিনিধিরা পাশে নেই

খাবার ও পানির হাহাকারে বন্যাদুর্গত মানুষ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ— এই তিন উপজেলায় ছয়দিনের টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পুরো এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্গত এলাকায় পৌঁছানো যায়নি সরকারি ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও বান্দরবান মহাসড়কের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকা এখনও পানির নিচে।

অন্যদিকে এমন ঘোর দুর্যোগের সময়েও পাশে নেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। বড় নেতাদেরও কেউ এলাকায় যাননি এখন পর্যন্ত। জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের এমন নির্লিপ্ত আচরণ দেখে ক্ষুদ্ধ বন্যাদুর্গতরা।

এদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ বিতরণ করতে আসা স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ত্রাণ ভাগ করে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকটি এলাকায় নৌকায় করে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিতে দেখা গেছে বিচ্ছিন্নভাবে। তবে পানির তীব্র স্রোতের কারণে ত্রাণ তৎপরতাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

এখনো ত্রাণ পৌঁছায়নি এমন একটি এলাকা সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ নাসির বলেন, ‘চারদিন ধরে বাড়িঘর ডুবে রয়েছে। আশপাশের উঁচু ভবনগুলোতে কয়েকশ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় দেশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছি।’

তিনি বলেন, ‘যার ঘরে যা ছিল, তা দিয়ে দুইদিন খাওয়া দাওয়া করা গেছে। এখন সেই খাবারও প্রায় শেষ দিকে। অনেক কষ্টে পাড়ার দুজনকে কেরানীহাটে পাঠিয়েও চাল ডালের মত নিত্য পণ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে পানীয় জলের অভাব। নলকূপগুলো ডুবে গিয়েছে। বৃষ্টির পানি ছাড়া খাবার পানির আর কোনো উৎস নেই।’

সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব বলেন, ‘জেলা প্রশাসন থেকে ১০ টন চাল বরাদ্দের খবর পেয়েছি, কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা সেই ত্রাণ এখনও হাতে পায়নি। আমার নিজের পক্ষ থেকে এক হাজার মানুষের জন্য আজ দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেছি।’

তবে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলাসহ চট্টগ্রামে এখন প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিন উপজেলায় ১৯ লাখ ২৫ হাজার নগদ টাকা এবং ৩৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের জন্য ৫০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

তবে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান জানিয়েছেন, ‘অতিরিক্ত পানির কারণে সাতকানিয়া এবং সীতাকুন্ডে এখনও ত্রাণ পৌঁছানো যায়নি।’

বুধবার (৯ আগস্ট) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়া অংশের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকার মানুষ কেরানীহাটের বিভিন্ন শপিং সেন্টার ও কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। কেরানীহাটের হক টাওয়ার, সিটি সেন্টার, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন শপিং সেন্টারে বন্যাদুর্গত এসব মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

সিটি সেন্টারের ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বন্যাকবলিত বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন এবং মার্কেটটির গ্রাউন্ড ফ্লোরে অন্তত দুই শতাধিক গবাদি পশুর ঠাঁই হয়েছে।

কেরানীহাট এলাকার ন্যাশনাল টাওয়ারের দোকানমালিক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গত দুদিন মার্কেটের নিচতলাটি পানিতে তলিয়ে ছিল। আজ পানি কমায় বিক্রি শুরু করেছি। সকাল থেকে মাত্র তিন ঘন্টায় আমার বেকারির অধিকাংশ মালামাল বিক্রি হয়ে গেছে।’

কেরানীহাট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি জয়নাল মাস্টার বলেন, ‘অন্তত ১০টি মার্কেটের ৪০০টি দোকান এই মুহূর্তে পানিতে তলিয়ে আছে। বিশেষ করে যেসব দোকান মার্কেটের নিচতলায় অবস্থিত তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরেও আমরা পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। ইতিমধ্যে ওষুধ, খাবারের দোকান এবং নিত্যপণ্যের দোকানগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বোতলজাত পানির সংকট সময়ের সাথে সাথে তীব্র হচ্ছে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকটি এলাকায় নৌকায় করে রান্না করা খাবার পৌছে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কিছু কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ পৌছালেও সেটা খুবই নগণ্য। বিশেষ করে উপজেলার চরতী, আমিলাইশ, নলুয়া ও কাঞ্চনা ইউনিয়নের বানভাসি মানুষগুলো চরম কষ্টে রয়েছেন। কারণ এসব এলাকার সড়কগুলোতে পানির অস্বাভাবিক স্রোতের কারণে সেখানে পৌঁছাতে পারছে না কেউ।

চন্দনাইশের দক্ষিণ হাশিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় ৫০টি পরিবার বিদ্যালয়টিতে আশ্রয় নিয়েছে। সাংবাদিক বা উৎসুক মানুষ স্কুলটির কাছ দিয়ে গেলেই লোহার ফটকের ভেতর দিয়ে হাত পেতে দিচ্ছেন। ত্রাণ পেতে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হাশিমপুর এলাকার ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় থাকা সত্তরোর্ধ্ব জরিফা খাতুন বলেন, ‘পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে গত সোমবার রাত থেকে আসছে আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। প্রথম দিন সঙ্গে করে নিয়ে আসা চাল ডাল ও আলু দিয়ে গতকাল দুপুর পর্যন্ত খেয়েছি। রাত থেকে আজ বিকাল পর্যন্ত চিড়া খেয়ে আছি, কোন ত্রাণ পাইনি। এমনকি কোনো জনপ্রতিনিধি একবারের জন্য দেখতেও আসেনি।’

এদিকে সাতকানিয়া-চন্দনাইশে বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধার অভিযান, ত্রাণ বিতরণসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় জনপ্রতিনিধিদের অবহেলা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বন্যাদুর্গতরা। ত্রাণ বিতরণ করতে আসা স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ত্রাণ ভাগ করে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

পশ্চিম আমিলাইশ গ্রামের বাসিন্দা আহমদ হোসেন বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুর থেকে কোনোভাবে শুকনা খাবার খেয়ে বউ-বাচ্চা বেঁচে আছি। স্থানীয় একটি ফাউন্ডেশন থেকে দুপুরে খিচুড়ি দিয়েছে। কিন্তু সরকারি কিংবা জনপ্রতিনিধিদের এখনো দেখা মেলেনি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) এর সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘মূলত আমরা কখনও এমন বন্যা দেখিনি। পুরো এলাকাই বন্যার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে ত্রাণ তৎপরতা ওভাবে শুরু করা যায়নি।’

এদিকে টানা বর্ষণে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এলাকায় লাখো মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করলেও তাদের পাশে নেই চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। আগামী ১১ আগস্ট সকাল সাড়ে নয়টায় বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনের কথা জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা স্থানীয়দের পাশে থাকার চেষ্টা করছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm