বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যখন প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছর পালন করছে, ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ তখন ধুঁকছে ‘রাজনৈতিক আইসিইউ’তে। সন্ত্রাসী, বিবাহিত ও অছাত্রদের ভারে সংগঠনটির কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। ছাত্র ও অবিবাহিতদের সংগঠন হলেও বর্তমানে নগর ছাত্রলীগের ৯৫ ভাগ নেতারই নেই ছাত্রত্ব। আবার ৭৫ ভাগ নেতাই বিবাহিত।
শুধুমাত্র গত এক বছরে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের ১৫ জন পদধারী নেতা বিভিন্ন অপরাধের কারণে আটক হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে শুধু একজন ছাড়া অভিযুক্ত আর কোনো নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং চিহ্নিত অনেক অপরাধীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদের ভার।
সদ্যসমাপ্ত বছরের ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের একটি ‘মধুকুঞ্জ’ থেকে একাধিক তরুণীসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন পাঁচলাইশ থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আব্দুল আল আহাদ। ৩১ আগস্ট বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ ফেনীতে র্যাবের হাতে আটক হন নগর ছাত্রলীগের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন এবং পাহাড়তলী থানা ছাত্রলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তানভিরুল ইসলাম সাজু।
গত ১৮ ডিসেম্বর চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হন ২৫নং রামপুরা ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন বাবু। গত সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে এক প্রবাসীর ২৭ ভরি স্বর্ণ মেরে দেয়ার অভিযোগে নগরের পাঁচলাইশ থানা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক জহিরুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ১৭ নভেম্বর প্রকাশ্যে দিনদুপুরে রাস্তায় প্রতিপক্ষকে কোপান নগর ছাত্রলীগের আরেক সদস্য ওয়াহিদ আলম ওয়াহিদ। চাঁদার টাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ নভেম্বর দিনদুপুরে প্রকাশ্য সড়কে আরিফ নামের এক যুবককে চাপাতি দিয়ে কোপান মহানগর ছাত্রলীগের সদস্য ওয়াহিদ আলম ওয়াহিদ। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
বছরজুড়ে এছাড়াও রয়েছে আরো বহু ছোট-বড় ঘটনা— যার সঙ্গে নগর ছাত্রলীগ নেতাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও যোগসাজশ রয়েছে।
বিভিন্ন সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ নেতারা সরাসরি জড়িত— এমন প্রমাণ মিললেও সব ঘটনার পরেই নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মুখে থাকে সেই একই বক্তব্য— ‘আমরা তদন্ত করে দেখছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেবো।’ কিন্তু সেই তদন্ত কখনও শেষ হয় না। আবার অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় কখনও। বরং অভিযুক্ত কোনো কর্মীর যদি পদবি না থাকে, তাকে পদবির ব্যবস্থা করে দিয়ে উল্টো পুরস্কৃত করার ঘটনাও অসংখ্য। ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা এসবের জন্য সভাপতি ইমরান হোসেন ইমু এবং সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে দায়ী করে থাকেন।
উদাহরণ হিসেবে নেতাকর্মীরা বলেছেন, কাজী নাঈম নামের এক কর্মীর বিরুদ্ধে মহসীন কলেজে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ব্যানার ছেঁড়ার প্রমাণ থাকলেও সেই কাজের ‘উপহার’ হিসেবে তাকে বানানো হয় মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক।
এছাড়া ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকার পরও অনেককে পদ উপহার দিয়ে নেতা বানানোর অভিযোগ রয়েছে বর্তমান নগর কমিটির বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, হালিশহর থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা এক যুবলীগ কর্মীকে ছাত্রলীগের সদস্য বানানো হয়। ওই একই কমিটিতে সদ্য মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে ফেরত আসা একজনকেও নেতা বানানো হয়।
আর এসব কমিটি করতে গিয়ে নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা ও একনায়কতন্ত্রের কারণে অযোগ্যরা নেতা বনে যাচ্ছে বলে জানান নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গোলাম সামদানী জনি। তিনি বলেন, ‘ইমু-দস্তগীর নিজেদের আজ্ঞাবহদের নেতা বানাতে গিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করেছে। এজন্য তারা কখনোই ক্ষমা পাবে না।’
অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরেই চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ ভুগছে অন্তর্কোন্দলে। নিজেদের স্বার্থে ছাত্রলীগের নেতারাই গড়ে তুলেছেন আলাদা আলাদা বলয়। এ যেন একঘরে থেকেও ‘সতীনের সংসার’ করা। বর্তমানে নগর ছাত্রলীগের পরিবারে চলছে এরকম তিন ‘সতীনের সংসার’। মহিউদ্দীন-নাছির গ্রুপের বর্তমান যে নতুন ‘সতীন’টি যোগ হয়েছে সেটি হল পদবঞ্চিত ছাত্রলীগের গ্রুপ। তাদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন রাজপথে থেকেও ইমু-দস্তগীরের কারণে তাদের কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তাই তারা পাল্টাকমিটি করে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।
এর আগে নগরীর ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর আন্দোলনে নামেন স্থানীয় ছাত্রনেতারা। স্বজনপ্রীতি ও গঠনতন্ত্রবিরোধী ‘প্যাকেজ কমিটি’ করার অভিযোগে আন্দোলন চলে ইমু-দস্তগীরের বিরুদ্ধে। সেই কমিটির বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে প্রতিবাদ জানানোর পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেই তদন্ত ঝিমিয়ে পড়ে অচিরেই। সম্প্রতি নগর ছাত্রলীগ ঘোষিত হালিশহর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিটির বিরুদ্ধে পাল্টা কমিটি দিয়েছে এই নতুন বলয়টি।
নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদ রাসেল যোগ করলেন, ‘আমাদের সভাপতি ইমু সাহেবও বিবাহিত। কদিন আগে তার ছোট ভাইয়েরও বিয়ে খেয়ে এলাম।’
নিজের বাচ্চার সাথে খেলতে খেলতেই আরেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মঈনুর রহমান বললেন, ‘প্রায় ১০টা বছর পদবিটা ধরে আছি। লজ্জা লাগে। কিন্তু আমরা বুঝি না ইমু- দস্তগীরের কেন এই বোধটা আসে না?’
২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর কাউন্সিল ছাড়াই সিলেকশনের মাধ্যমে ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৪ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর কিছুদিন পর ২৯১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়। পরে জাকারিয়া দস্তগীরকে সাধারণ সম্পাদক বানানো হলেও সেই কমিটির বয়স এখন পুরো এক দশকের দুয়ারে। কমিটির অনেকেই বিয়েশাদি করে পেতেছেন সংসার, অনেকে ব্যস্ত চাকরি-বাকরি-ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। কিন্তু কমিটি চলছে তো চলছেই— বছরের পর বছর ধরে।
২৯১ সদস্যবিশিষ্ট নগর ছাত্রলীগের কমিটিতে বর্তমানে প্রায় অর্ধেক নেতাই বিবাহিত। বাকিরা চাকরি ও ব্যবসার সাথে যুক্ত। হাতেগোণা দু-চারজন ছাড়া ছাত্রত্ব নেই কারোরই। অথচ ছাত্রলীগের সংবিধানে স্পষ্ট করেই লেখা আছে, বিবাহিত, অছাত্র ও চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী কেউ ছাত্রলীগের নেতা হতে পারবেন না।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইমু-দস্তগীরের বিপক্ষে অনাস্থা প্রকাশ করেন বর্তমান কমিটির ৪৬ জন নেতা। এছাড়া নগর ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিকে অকার্যকর ও মেয়াদউত্তীর্ণ অভিহিত করে নতুন কমিটির দাবিতে মিছিল-বিক্ষোভও হয়েছে একাধিকবার। মহানগর কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-সম্পাদক নাছির উদ্দীন কুতুবী ওই সময় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ ২৯১ সদস্যের কমিটিতে ৫৬ জন বিবাহিত ও ১৬২ জনই অছাত্র।’
সিপি