তরুণীদের ফাঁদে ফেলে চট্টগ্রামের ‘মার্ক-সাকারবার্গ’ ভিডিও বেচে ৪ লাখ গ্রাহকের কাছে
২০ হাজার অশ্লীল ভিডিও, ৩০ হাজার কনটেন্ট
কৌশলে টার্গেট করা তরুণীদের ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট হ্যাক করে সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে দাবি করা হয় টাকা। টাকা দিতে না পারলে প্রস্তাব দেওয়া হয় ভিডিও কলে নগ্ন অবস্থায় আসার। সেই প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভুক্তভোগী তরুণীদের নাম-পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে। অনন্যোপায় যেসব তরুণী ভিডিও কলে নগ্ন হয়ে আসেন, তাদের নিয়েই শুরু হয় অন্য বাণিজ্য। আপত্তিকর সেইসব ভিডিও চড়া মূল্যে দেশে-বিদেশে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই ধরনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেক তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন।
অনলাইনে এভাবে ভয়াবহ অপরাধের জাল বিস্তার করেছিল ‘পমপম’ নামে একটি টেলিগ্রামভিত্তিক গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার তরুণী এভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আসছিল। চক্রটি মূলত চট্টগ্রামভিত্তিক। যদিও গ্রুপের বেশকিছু ‘এডমিন’ ঢাকায় থাকেন। তবে গ্রুপটির মূল নেতৃত্বে রয়েছেন চট্টগ্রামের এক তরুণ। অনলাইনে ওই তরুণ ‘মার্ক-সাকারবার্গ’ নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম আবু সায়েম। চট্টগ্রাম নগরীর চট্টগ্রামের লালখানবাজার এলাকায় তার বাসা। ২০ বছর বয়সী সায়েম চট্টগ্রামের শ্যামলী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল বিভাগে ডিপ্লোমা করেছেন। তার আগেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ভয়াবহ এই অপরাধের সঙ্গে। আবু সায়েমের ব্যাংক একাউন্টে ইতিমধ্যে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখানবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে আবু সায়েমকে গ্রেপ্তার করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পরে চট্টগ্রাম নগরীর একটি হাউজিং এলাকা থেকে অভ্র এবং উখিয়া থেকে শাকিল নামের আরও একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া সায়েমের প্রধান সহযোগী চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে কর্মরত ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমানকে কর্ণফুলী উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একইসঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসিমকেও।
সবমিলিয়ে চক্রটির মূলহোতা সায়েমসহ ৯ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। এরা হলেন— মার্ক-সাকারবার্গ ওরফে আবু সায়েম, শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, জসিম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ ও মিয়া ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।
রোববার (২২ মে) রাজধানীর মালিবাগে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাওয়ার পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চক্রটিকে শনাক্তের কাজ শুরু করে সিআইডির সাইবার পুলিশ।
জানা গেছে, সম্প্রতি আরাফাত নামে এক ভুক্তভোগী এবং তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি গ্রুপে ছড়িয়ে দেয় সায়েম। এ ঘটনায় সায়েমের বিরুদ্ধে ডিএমপির তেজগাঁও থানায় পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। এরপরই তদন্তে নামে সিআইডি।
সিআইডি প্রধান জানান, চক্রটির মূল হোতা সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে ‘মার্ক-সাকারবার্গ’ আইডিটি লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে ‘পমপম গ্রুপের’ যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপ আছে— তার অ্যাডমিনদের নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়। অ্যাডমিনদের কাজ ছিল মার্ক ওরফে সায়েমের হয়ে নতুন নতুন কনটেন্ট জোগাড় করা। নতুন কনটেন্ট পেতে তারা ভুয়া এনআইডি বানিয়ে টার্গেট ব্যক্তিদের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো।
তিনি বলেন, ‘তবে বর্তমানে তাদের খুব বেশি কষ্ট করতে হতো না। কারণ ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকরাই নতুন নতুন কনটেন্ট সরবরাহ করতো। তারা সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করতো, পরে প্রতিশোধের নেশায় সেগুলোই তুলে দিতো ওই গ্রুপে। সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে, ৩০-৪০ সেকেন্ডের ভিডিও বানিয়ে আপলোড করা হতো। ভিডিও দেখে যারা ‘ফুল-ভার্সন’ দেখতে চাইতো, তাদের এক থেকে দুই হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হতো।’
সিআইডি প্রধান বলেন, ‘মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো দেশের ক্রেতারা গ্রুপটির সদস্য হতো। তারা ওইসব কনটেন্ট কিনে সংরক্ষণ করতো।’
সিআইডি-প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে পেজের অ্যাডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা হয়। সায়েমের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। তার দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া। মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। তাকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। একইসঙ্গে গ্রেফতার করা হয় তার সহযোগী জসিমকেও।
তিনি বলেন, ‘সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রুপগুলোর অনেক অ্যাডমিন ঢাকায় অবস্থান করছে। তাদের গ্রেফতারে বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট-টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেফতার হয় অ্যাডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিয়া ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।’
সিআইডি প্রধান বলেন, ‘সায়েম এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোতে সাবস্ক্রাইবার বা গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার কনটেন্ট রয়েছে। অপরদিকে মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় দুই হাজার ৭৫০ জন। আমরা তাদের বিস্তারিত তথ্য পেয়েছি। তাদের নিয়েও কাজ করছি।’
সিপি