তক্ষকের নিষ্ঠুর ব্যবসা চট্টগ্রামের পাহাড়ে পাহাড়ে, অপহরণ-গুম-খুন সবই হয় (ভিডিও)

রাজনীতিবিদ থেকে শিল্পপতি— সিন্ডিকেটে জড়িত অনেকেই

তক্ষক লাগবে, তক্ষক— যে কোনো মূল্যে, যেভাবেই হোক। তক্ষক চাই-ই চাই। স্থানীয় ভাষায় এর নাম টোট্টেং। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে এই তক্ষক নিয়ে অন্তত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে রীতিমতো উন্মাদনা চলে আসছে। তক্ষক ধরে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে একদল মানুষ ছুটছে তো ছুটছেই। চট্টগ্রামের পাহাড়ি উপজেলা ফটিকছড়ি থেকে রাঙামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি পর্যন্ত তক্ষক বেচাকেনার নেশায় ছুটছে সেই মানুষগুলো। সেই দলে সাধারণ লোক যেমন আছেন, আছেন সামাজিকভাবে প্রভাবশালী মানুষ, তেমনি আছে পেশাদার প্রতারকও। লোকচক্ষুর আড়ালে সেখানে যেমন আছে কোটি কোটি টাকা হারানোর মর্মন্তুদ গল্প, তেমনি গহীন জঙ্গলে তক্ষক কিনতে যাওয়া লোককে অপহরণ কিংবা খুনের ঘটনাও ঘটে প্রায়ই। এসবের বেশিরভাগই থেকে যায় অজানা।

সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বনাঞ্চল থেকেই বেশিরভাগ তক্ষক ধরা হয়ে থাকে। ফলে পাহাড়ি জেলা ও উপজেলাগুলোতে অনেকদিন ধরেই সক্রিয় তক্ষক পাচারকারীরা। সেখানে বিভিন্ন এলাকায় তক্ষক পাচারকারীরা স্থানীয়দের কোটি টাকার লোভ দেখায়। তাদের বলা হয়, একেকটি তক্ষকের মূল্য কোটি টাকা। এভাবে দেশের বাইরে পাচার এবং পাচারকারীদের হাতে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় পাঁচ হাজারেরও বেশি তক্ষক হারিয়ে গেছে। অথচ বন্য প্রাণী আইন ২০১২ এর ৩২ ধারা মতে তক্ষকজাতীয় প্রাণী ধরা ও পাচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তক্ষকের খোঁজে নেমে সর্বস্ব হারানোর গল্প

চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারের বাসিন্দা সিদ্ধার্থ খাস্তগীর তক্ষক ব্যবসায় নেমে রীতিমতো পথের ফকির হয়ে যান। হাজার হাজার কোটি আয়ের স্বপ্ন নিয়ে এই যুবক তক্ষক ব্যবসা করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে কোটি কোটি টাকা হারান। ধার হিসেবে বিভিন্নজনের কাছ থেকে নেন কয়েক কোটি টাকা। তক্ষকের ব্যবসায় ঢেলে ওই টাকাও হারান তিনি। ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে বছরকয়েক আগে একসময় এলাকা থেকে পালিয়ে যান। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তার আর খোঁজ মেলেনি।

সাধারণ মানুষই শুধু নন, চট্টগ্রামের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নামিদামি শিল্পপতিরাও তক্ষক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এ ব্যবসা করতে গিয়ে ২০১১ সালে দালালের খপ্পরে পড়ে নিহত হন রূপক নন্দী নামে এক ব্যক্তি। তার বাড়ি ফটিকছড়ি নারায়ণহাট এলাকার নন্দীপাড়ায়।

২০১৮ সালে তক্ষক ব্যবসায়ীর ছদ্মাবরণে একদল প্রতারক চট্টগ্রাম নগরীর আছদগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রতন দত্তের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। সেই শোকে এর কিছুদিন পরই তিনি স্ট্রোক করে মারা যান। তার সঙ্গে লেনদেন ছিল নগরীর জামালখান এলাকার অবাঙালি এক পেট্রোল পাম্পের মালিকের। তিনি এখন ইউরোপে থাকেন।

তক্ষকের ব্যবসা ঘিরে অপরাধের বিস্তার

তক্ষকের ব্যবসা ঘিরে বাড়ছে অপরাধের ঘটনা। এর অনেকগুলোই রীতিমতো নৃশংস। তক্ষক পাচার নিয়ে বিরোধের জের ধরে ঘটছে খুনের ঘটনাও। কথিত এই ব্যবসায় জাল টাকার ব্যবহারও হচ্ছে অহরহ। ঘটছে মাদকের বিস্তারও। লোভে পড়ে অনেক মাদকব্যবসায়ীও তক্ষক ব্যবসায় নেমে পড়েছে। মূলত তক্ষক পাচারকারীদের মাধ্যমেই জাল টাকা ও মাদকের বিস্তার ঘটছে।

তক্ষক ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মধ্য বেতছড়ির গোরস্থান পাড়ার যুবলীগ নেতা মোশারফ হোসেনকে (৩২) দুর্বৃত্তরা খুন করে।

এই ঘটনার ছয় মাসের মাথায় গত বছরের ২৩ নভেম্বর তক্ষক ব্যবসার সূত্র ধরে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এনে খুন করা হয় ঢাকার এনজিও ‘সেতু বন্ধনের’ ম্যানেজার হেলাল উদ্দিনকে। কোটি টাকা দামের কথিত তক্ষক কম দামে বিক্রির লোভ দেখিয়ে ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকার এনজিও ‘সেতু বন্ধনের’ ম্যানেজার হেলাল উদ্দিনকে (৪৩) কৌশলে ফটিকছড়ি আনা হয়। এরপর তাকে অপহরণ করে একটি চক্র। পরে তক্ষকের দাম নিয়ে ওই চক্রের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তাকে একপর্যায়ে হত্যা করা হয়। ওই এনজিও কর্মকর্তার লাশ গুম করতে সেটি ফেলে দেওয়া হয় ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুরের নির্জন পাহাড়ি এলাকার ৫০ ফুট গভীর এক গর্তে।

তক্ষক কিনতে আসা এনজিও কর্মকর্তার লাশ গুম করতে সেটি ফেলে দেওয়া হয় নির্জন পাহাড়ি এলাকার ৫০ ফুট গভীর এক গর্তে।
তক্ষক কিনতে আসা এনজিও কর্মকর্তার লাশ গুম করতে সেটি ফেলে দেওয়া হয় নির্জন পাহাড়ি এলাকার ৫০ ফুট গভীর এক গর্তে।

এক বছর পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর হাতে দুই অপহরণকারী গ্রেপ্তার হওয়ার পর লাশ গুমের সেই জায়গা খুঁজে বের করেন পিবিআই কর্মকর্তারা। গত ১৯ নভেম্বর ৫০ ফুট গভীর সেই গর্ত খুঁড়ে এনজিও কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের গলিত দেহ উদ্ধার করা হয়।

তক্ষক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ইলিয়াছ নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি রাঙামাটি থেকে চারটি তক্ষক কিনে এনেছিলেন। বিক্রির জন্য তার এক পরিচিত লোকের কাছে দিয়ে পেয়েছিলেন মাত্র ৬০ হাজার টাকা। তবে এর দাম ‘অনেক‘ শুনে তিনি পরে আবার রাঙামাটি যান তক্ষকের খোঁজে। সেখানে যাওয়ার পর ওখানকার সিন্ডিকেটের লোকজন তাকে ধরে মারধর করে। তার টাকা পয়সা মোবাইল সব কিছু রেখে দেয়। শেষে তিনি অনেকটা প্রাণ হাতে নিয়ে রাঙামাটি থেকে পালিয়ে আসেন।

গুজবই ‘তক্ষক ব্যবসা’র মূল পুঁজি

তক্ষকের ব্যবসা পুরোটাই গুজবের ওপর নির্ভর। গুজব আর টাকার লোভই মূলত কথিত এই ব্যবসাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। তক্ষকের দাম ও তক্ষক দিয়ে তৈরি ওষুধ নিয়ে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হয় পরিকল্পিতভাবেই। সেই গুজব বিশ্বাস করে কিছু লোক রাতারাতি ধনী হবার স্বপ্ন নিয়ে তক্ষক শিকারে নামে। এদের বেশিরভাগই আবার নিপুণ প্রতারক। অথচ ছড়ানো গুজবের সবটাই মিথ্যা। তক্ষক দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ওষুধের ‘উপকারিতা’ নিয়ে সেসব কথা শোনা যায়, বৈজ্ঞানিকভাবে তার কোনো ভিত্তি নেই। সংঘবদ্ধ চক্র প্রচার করে থাকে— তক্ষক দিয়ে এইডস, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের ওষুধ তৈরি হয়। চীনে যদিও আয়ুর্বেদীয় কিছু ওষুধ তৈরিতে তক্ষক ব্যবহার করা হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তক্ষকের কিছুটা দাম ও চাহিদা থাকলেও যেভাবে প্রচার করা হয়, ততোটা কখনোই নয়। অথচ কেবল এইসব গুজবের কারণেই প্রাণীটি অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় রয়েছে। মূলত সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র নানা গুজব ছড়িয়ে তক্ষকের পেছনে মানুষকে লেলিয়ে দিচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে— এমন ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তক্ষক বিক্রি হয় চড়ামূল্যে। তক্ষকের ওষুধি গুণ রয়েছেও তারা দাবি করে। কোনো কোনো দেশে এ দিয়ে ওষুধও তৈরি করে থাকতে পারে বলে তাদের ধারণা। কেউ কেউ বলেন, তক্ষককে পুরো গলিয়ে ক্যান্সারসহ দূরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরি করা হয়। এই প্রাণি কাউকে কামড় দেওয়ার পর তার ঘা শুকিয়ে গেলে ওই ব্যক্তির শরীরে কোনো ধরনের রোগ-জীবাণু থাকবে না। আবার কেউ কেউ বলেন, এটার শরীরে থাকা দানা এক করে ড্রোন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। অনেক বলেন, তক্ষক ঘরে থাকলে লাখ লাখ টাকা আসে। কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। বাস্তবে এসব পুরোটাই গুজব। এসব দাবির সপক্ষে প্রমাণিত কোনো সত্যতা এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরাই নিশ্চিত করে বলছেন, বাস্তবে ক্যান্সারের ওষুধ কিংবা কেমো— কোনো কিছুই তক্ষক দিয়ে তৈরি হয় না।

অথচ এমন সব গুজবের ওপর ভর করে চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে সংঘবদ্ধ চক্র নির্বিচারে তক্ষক ধরছে। এরপর কথিত এসব মহামূল্যবান’ তক্ষক গছিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অনেকে এমনকি তক্ষকের কঙ্কাল বিক্রি করেও প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

অনেকের দাবি, ২০০ গ্রাম ওজনের তক্ষকের দাম এক কোটি টাকা! অথচ তক্ষকের দাম লাখ টাকাও নয়। এর দাম পাঁচ-দশ টাকার বেশি হবে না বাস্তবে। কারণ তক্ষকে মূল্যবান কিছুই নেই। বরং সমানে তক্ষক নিধনের কারণে প্রাণীটির চিরতরে বিলুপ্তি ঘটবে। অথচ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কিভাবে হয় বেচাকেনা?

চট্টগ্রামের পাহাড়ি উপজেলা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তক্ষক কেনার জন্য ক্রেতারা আসেন। তবে সারা দেশেই এখন তক্ষক বেচাকেনার সিন্ডিকেট আছে। চট্টগ্রামের বাইরে থেকে যারা কিনতে চান, তারা চট্টগ্রামভিত্তিক সিন্ডিকেটগুলোর কাছে তক্ষকের ছবি চেয়ে চাহিদা জানান। ছবি পছন্দ হলে দিতে হয় সদ্য করা ভিডিও। বাধ্যতামূলকভাবে এই ভিডিও কোনো পত্রিকার ওপরে থাকা তারিখের পাশে রেখে করতে হয়। এই ভিডিও বিশ্নেষণ করার পর সম্ভাব্য ক্রেতা চট্টগ্রামে আসেন।

তক্ষক বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর-দাম হয় দুইভাবে। একটা থোক। আরেকটা স্ক্যান করে প্রাণির শরীরে থাকা ‘দানা’ হিসাব করে। তবে বেশিরভাগ বিক্রেতা স্ক্যানের বিপক্ষে। তারা ‘থোক’ দরদাম করেন। সাধারণত দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে এক একটি তক্ষকের দাম নির্ধারিত হয় বলে জানা গেছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কথিত এসব ক্রেতার কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। অবশ্য এই ধরনের ঘটনায় প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা পুলিশের কাছেও যেতে চান না। আবার বিষয়টি বেআইনি হওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও অনেকে পুলিশের কাছে যেতে পারেন না।

পাচারকারীরা ধরা পড়ে সামান্যই

পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো কোনো সময় অভিযান চললেও তক্ষক পাচারে তা তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। উল্টো পাচারকারী চক্রের দেখানো লোভে পড়ে পার্বত্য এলাকাকেন্দ্রিক স্থানীয় চক্রগুলো তক্ষকের পাশাপাশি পাহাড়ের দুর্লভ প্রজাতির বিভিন্ন প্রাণীও নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কয়েকজনকে আটকের পাশাপাশি শতাধিক তক্ষক উদ্ধার করলেও এরই মধ্যে অনেক জনপদ তক্ষকশূন্য হয়ে পড়েছে।

গত ৬ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের লামায় বিরল প্রজাতির পাঁচটি তক্ষকসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ। লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের বাইশপারি রাস্তার মাথা থেকে আটক এই তিন ব্যক্তি হলেন গজালিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মোহাম্মদ পাড়ার মৃত বেলালের ছেলে নুরুজ্জামান (২৫), ঝালকাঠি জেলার নলচিটি থানার কামদেরপুর এলাকার খালেক হাওলাদারের ছেলে খাইরুল হাওলাদার এবং নলচিটি থানার কামদেরপুর এলাকার মুজে আলী হাওলাদারের ছেলে আলকাছ হাওলাদার। তার আগে লামার পাশের উপজেলা আলীকদমের চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের রেপারপাড়া বাজার চৌধুরীর বাড়ি থেকে ১৬ লাখ টাকাসহ তক্ষকের ক্রেতা-বিক্রেতাকে আটক করেছিল পুলিশ।

গত ২৫ মে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বেলছড়িতে পুলিশের অভিযানে মো. জাফর (৩৮) মো. ইব্রাহিম (২৪) ও জাহাঙ্গীর আলম (২৬) নামে তিন তক্ষক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি তক্ষক উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত ১৭ মে তক্ষক বাণিজ্যের টাকা লেনদেনের সময় এক লাখ টাকার জাল নোটসহ দুই তক্ষক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী। এরা হলেন নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও এলাকার শাহাদাত হোসেন (৩৯) এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মধ্য বেতছড়ি গোরস্থান পাড়া এলাকার সাইদুল ইসলাম (২৭)।

গত বছরের জানুয়ারিতে রাঙামাটির কোতোয়ালী থানা পুলিশের অভিযানে দুটি তক্ষকসহ চার তক্ষক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। এরা হলেন রাঙামাটি শহরের বিহারপুরের বাসিন্দা অমর জ্যোতি চাকমা (৩৬) ও প্রতিবাবু চাকমা (২৮), পুলিশ লাইন আপার রাঙামাটি এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন (৫৫) এবং খাগড়াছড়ির পানছড়ির মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম (২৫)। ওই সময় পুলিশ জানায়, সংঘবদ্ধ পাচারকারী দলের এই সদস্য আটকের দুই দিন আগে একটি চক্রকে তক্ষক দেওয়ার নাম করে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর একইভাবে ৮ লাখ টাকা মূল্য ঠিক করে আবারও আরেকটি পক্ষকে তক্ষক সরবরাহের নামে প্রতারণার অপেক্ষায় ছিল চক্রটি।

কেমন প্রাণী তক্ষক?

তক্ষক মূলত গিরগিটি প্রজাতির। পিঠের দিক ধূসর, নীলচে-ধূসর বা নীলচে বেগুনি-ধূসর। সারা শরীরে থাকে লাল ও সাদাটে ধূসর ফোঁটা। পিঠের সাদাটে ফোঁটাগুলো পাশাপাশি ৭-৮টি সরু সারিতে বিন্যস্ত। কমবয়সী তক্ষকের লেজে পরপর গাঢ-নীল ও প্রায় সাদা রঙের বলয় রয়েছে। মাথা অপেক্ষাকৃত বড়, নাকের ডগা চোখা ও ভোঁতা। চোখ বড় বড়, মণি ফালি গড়নের। লেজ সামান্য নোয়ানো। দৈর্ঘ্য নাকের ডগা থেকে পা পর্যন্ত ১৭ সেমি এবং লেজও প্রায় ততটা।

তক্ষকের ডাক চড়া, স্পষ্ট ও অনেক দূর থেকে শোনা যায়। ডাকের জন্যই এই নাম। কক্‌কক্‌ আওয়াজ দিয়ে ডাক শুরু হয়, অতঃপর ‘তক্‌-ক্কা’ ডাকে কয়েক বার ও স্পষ্টস্বরে। এরা কীটপতঙ্গ, ঘরের টিকটিকি ছোট পাখি ও ছোট সাপ খেয়ে থাকে। ছাদের পাশের ভাঙা ফাঁক-ফোঁকড় বা গর্তে অথবা গাছে বাস করে।

তক্ষক রাতে খুব পরিষ্কার দেখতে পায়। তক্ষকের অক্ষি গোলকে ট্রান্সপারেন্ট মেমব্রেন থাকে যা তাকে মানুষের চেয়ে ৩৫০ গুণ বেশি দৃষ্টি সম্পন্ন করেছে। তক্ষক আল্টা ভায়োলেট রশ্মিতেও( বেগুনি ও সবুজ ) খুব পরিষ্কার দেখতে পায়। অন্যান্য আত্মরক্ষী প্রাণীদের মত তক্ষকের ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দাপুটে। এটি নিজের শরীরের লেজ, দাঁত ,পা প্রভৃতি হারালেও আবার প্রাকৃতিক ভাবে গজাতে পারে‌।

তক্ষক দক্ষিণ এশিয়ায় বিপন্ন একটি প্রাণী। ব্যাপক নিধনই তক্ষক প্রজাতির বিপন্ন হওয়ার মূল কারণ। অনেকে ভুলক্রমে তক্ষককে বিষাক্ত সরীসৃপ হিসেবে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বাস।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!