ঢাকার ডাকে চট্টগ্রামের সমন্বয়করা সাড়া দিচ্ছেন না, শনিবারও যাচ্ছে না কেউ
চট্টগ্রাম থেকে অনিয়মের অভিযোগ জমছে ঢাকায়
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতা ও অসদাচরণের অভিযোগ ওঠার পর তাদের ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মহানগর ও চট্টগ্রাম জেলার সমন্বয়কদের শনিবার সকাল ১১টায় রাজধানীর বাংলামটরের রূপায়ন টাওয়ারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে। তবে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশ ঢাকার বৈঠকে যাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর সপ্তাহখানেক আগেও একবার এভাবে ঘোষণা দিয়ে ঢাকায় যাননি চট্টগ্রামের সমন্বয়করা। এর মধ্য দিয়ে ঢাকার সমন্বয়কদের সঙ্গে চট্টগ্রামের নেতাদের দূরত্বের বিষয়টি প্রথমবারের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
১৪ নভেম্বর রাতে ফেসবুকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্তর্গত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মহানগর ও চট্টগ্রাম জেলাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের মাঝে সমন্বয়হীনতা অসদাচরণের অভিযোগ এসেছে। তাই এই অভিযোগের সুষ্ঠু পর্যালোচনা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উক্ত স্থানসমূহের সকল প্রতিনিধিকে (কেন্দ্রীয়ভাবে লিস্টেড) আগামী ১৬ অক্টোবর শনিবার সকাল ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার অনুরোধ করা হলো।’
এর পরপরই চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি সেখানে মন্তব্য করেন, ‘ঢাকাকেন্দ্রিক জিনিসগুলো বন্ধ করুন। চট্টগ্রাম থেকে ৭০ জন ঢাকায় যাবে, নাকি ঢাকা থেকে ৫/৭ জন চট্টগ্রাম আসবে? আপনারা সিদ্ধান্ত নেন।’
পরে তিনি ফেসবুকে তার ভেরিফাইড একাউন্টে লিখেন, ‘অনেক কিছুই দেখছি ঢাকাকেন্দ্রিক হচ্ছে। ঢাকার বাহিরের প্রতি মূল্যায়ন বাড়ান, নয়তো এগুলো শোভনীয় কিছু বয়ে আনবে না। আরও অনেক বিষয় আছে। যাই হোক, ঢাকাকেন্দ্রিক জিনিসগুলো দয়া করে বন্ধ করুন। পুরোনো সংস্কৃতি আমরা চাই না। বীর চট্টলাকে কোনোভাবে ছোট করে দেখার সুযোগ নাই, এখানে ইতিহাস তৈরি হয়। আর হ্যাঁ, ঢাকায় থাকলেই হবে, নয়তো হবে না— এইসব জিনিসপত্র থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে ৭০/৮০ জন ঢাকায় যাবে নাকি ঢাকা থেকে ৪/৫ জন চট্টগ্রাম আসবে? আপনারা সিদ্ধান্ত নেন। আমরা কিন্তু পুতুল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ঢাকা কেন্দ্রীকতার বিরুদ্ধে এবং ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছি। সবকিছুর বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।’
জানা গেছে, এর আগে গত রোববারও (১০ নভেম্বর) একইভাবে চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার চট্টগ্রামের সমন্বয়কদের ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় অফিসে যেতে বলা হয়েছিল।
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নারী সমন্বয়ক নাফিজা সুলতানা অমি জানান, বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের সমন্বয়কদের একটি অংশ কেন্দ্রে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এসব অভিযোগের বিষয় মীমাংসা করতে চট্টগ্রামের সকল সমন্বয়ককে ১০ নভেম্বর ঢাকায় ডেকেছিল কেন্দ্রীয় কমিটি। তবে ওই সভায় যাতে চট্টগ্রাম থেকে কেউ যোগ না দেয় সেই বিষয়ে বাকি সমন্বয়কদের চাপ দেন খান তালাত মাহমুদ রাফি। শেষ পর্যন্ত সভাটি আর হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নারী সমন্বয়কদের হয়রানি করছেন শীর্ষস্থানীয় পুরুষ সমন্বয়করা। কোনো বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করলেই তাদের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং লেলিয়ে দেওয়া, অনলাইনে হয়রানিসহ অন্যান্য সমন্বয়কদের দিয়ে অপদস্ত করা হয়। এমন সব অভিযোগ তুলেছেন নারী সমন্বয়করা। অন্যদের পাশাপাশি এমন অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির বিরুদ্ধেও। কয়েকজন সমন্বয়কের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগও মিলেছে এর পাশাপাশি।
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক অতিরিক্ত স্বেচ্ছাচারী আচরণ করছেন— এমন অভিযোগ তুলে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নারী সমন্বয়ক নাফিজা সুলতানা অমি জানান, কোনো কোনো সমন্বয়কের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করলে বা সেসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে অন্য সমন্বয়কদের বিভিন্নভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে।
গত শনিবার (৯ নভেম্বর) রাতে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে নাফিজা সুলতানা অমি বলেন, ‘প্রতিবাদ করার ফলে ভাইদের যতোটা না অপমান-অপদস্থ করেছে, তার থেকেও বেশি অপমান-অসম্মান করা হয়েছে নারীদের। এমনকি যে বোনেরা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাদেরকেই তারা বাজে ইঙ্গিত, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা এমনকি বডি শেমিং করতেও ছাড় দেয়নি। কিশোর গ্যাংকে বৈধতা দিয়ে একজন নারীকে কীভাবে সাইবার বুলিংয়ের জন্য লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটার প্রমাণও হাতে আছে।’
কী ধরনের অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সমন্বয়কদেরকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে তার বিবরণও দিতে গিয়ে অমি বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে সমন্বয়কদের ৩২ জনের একটা টেলিগ্রাম গ্রুপ ছিল। সেই গ্রুপে হুট করে সদস্য বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ৮০-৮১ তে গিয়ে ঠেকেছে। এদের মধ্যে উদয় হয়েছে ক্ষ্যাতনামা (খ্যাতনামা’র ব্যঙ্গার্থ) মাস্টারমাইন্ডরা এবং উড়ে এসে জুড়ে বসা সমন্বয়কবৃন্দ। ব্যাপারটা এইটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এতটুকুতেই ঠেকেনি। শুরু হয় স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ফুটেজবাজি, সমন্বয়হীনতা এবং চবিকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট। সব স্থানেই এই তিন ক্যাটাগরির মানুষরাই প্রায়োরিটি পেতে থাকে। এসবের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে অপমান-অপদস্থ করে গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ট্যাগ লাগিয়ে দেয় স্বার্থান্বেষী অথবা ছাত্রলীগের হেল্পার।’
নাফিজা সুলতানা অমি বলেন, ‘এসবের প্রেক্ষিতে সমন্বয়ক গ্রুপে কথা বলতে গিয়ে রাফির ঘনিষ্ঠ সমন্বয়কদের দ্বারা অমি বিভিন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ আক্রমণের শিকার হয়েছি।’ অমি বলেন, ‘এ সবকিছু দেখার পরেও আমাদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি একদম নিশ্চুপ ছিল। নারীদেরকে যেভাবে অপমান, অপদস্থ করা হয়েছে এবং যারা করেছে তাদের সাথেই রাফির ওঠাবসা সবসময়ই।’
এদিকে বিক্ষুদ্ধ সমন্বয়করা অভিযোগ তুলেছেন, নির্দিষ্ট গ্রুপের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করলেই তাদের বিরুদ্ধে ডট গ্যাং নামে একটি কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যদের লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের আলোচিত কিশোর গ্যাং ‘ডট গ্যাং’য়ের সদস্য নগরীর স্বনামধন্য তিনটি স্কুলের অন্তত ৪০ শিক্ষার্থী। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই গ্যাং-এর সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তখন র্যাব জানিয়েছিল, ওই সাতজনই চট্টগ্রাম নগরের স্বনামধন্য স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। তাদের কারও বাবা চিকিৎসক, আবার কারও বাবা সরকারি কর্মকর্তা। তাদের সবার বয়সও অভিন্ন— ১৬ বছর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় দেড় বছর আগে ‘ডট গ্যাং’ নামে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে মূলত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ‘হিরোইজম’ দেখানোর লক্ষ্য নিয়ে। সেই থেকে তারা স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উত্যক্ত, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, মারামারিসহ বিভিন্ন অপরাধ করে আসছিল।
গণঅভ্যূত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি ও তার ঘনিষ্ঠ আরেক সমন্বয়ক রিজাউর রহমানের বিরুদ্ধে ‘ডট গ্যাং’ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ডট গ্যাং-এর সদস্যদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের বেশ কিছু প্রমাণ এর মধ্যেই চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী সমন্বয়কদের আনা অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অভিযোগগুলো অনেকাংশে সত্য। তবে যার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ উঠেছে— এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়াই ভালো হবে।’
সিপি