ভিডিও/ ডিজিটাল বিলবোর্ডের নৈরাজ্য চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারে, ঝুঁকি বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনার
দরপত্র ছাড়াই তুলে দেওয়া হয় বিশেষ প্রতিষ্ঠানের হাতে
২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বিলবোর্ডের নৈরাজ্য থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ চালু করেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। ওই সময় টানা অভিযান চালিয়ে সব ধরনের বিলবোর্ড অপসারণ করা হলেও তার পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ বেলায় এসেই করে গেছেন উল্টো কাজ। মেয়াদের শেষবেলায় ডিজিটাল বিলবোর্ড ও ডিজিটাল টিভিস্ক্রিন বসানোর অনুমতি দিয়ে গেছেন চসিক মেয়র নিজেই। সেখানে আউটসোর্সিংয়ের অজুহাত দেখিয়ে মানা হয়নি দরপত্রের নিয়মনীতিও। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, যেখানে সেখানে ডিজিটাল বিলবোর্ড ও টিভিস্ক্রিনের আড়ালে ঢেকে গেছে চট্টগ্রাম শহরের সবুজ জমিন ও নীল আকাশ।

২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিষ্ঠানকে বছরে মাত্র দেড় কোটি টাকার ট্যাক্স দেওয়ার শর্ত দিয়ে সাড়ে ৬ কিলোমিটারের ফ্লাইওভারটিতে বিজ্ঞাপন বসানোর ইজারা দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। চুক্তিটি হয় ৫ বছরের জন্য।
সরেজমিনে দেখা যায়, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচে শতাধিক ডিজিটাল বিলবোর্ডের রঙিন আলোর ঝলকানিতে ছেয়ে গেছে ফ্লাইওভারের প্রতিটি পিলার। একই সঙ্গে মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে ডিজিটাল টিভি স্ক্রিনও। সন্ধ্যার পর বিচিত্র আলোর ঝলকানিতে বিব্রতকর ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়ছেন সড়কে চলাচলরত ছোট-বড় গাড়ির চালকরা। শুধু চালকরাই নন, প্রতিমুহূর্তে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন পথচারীরাও।
চট্টগ্রাম নগরের আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচে জিইসি থেকে লালখানবাজার এলাকাজুড়ে প্রতিদিনের চিত্রই এটি। সেখানকার প্রতিটি পিলারের উভয় পাশে বসানো হয়েছে ডিজিটাল বিলবোর্ড ও ডিজিটাল টিভিস্ক্রিন। বসানো হয়েছে শতাধিক বিলবোর্ডের ফ্রেমও। অধিকাংশ বিলবোর্ডে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। ডিজিটাল টিভিস্ক্রিনেও দিন-রাত বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের প্রচার করা হচ্ছে।
একাধিক গাড়িচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে নগরে কোনো ধরনের ডিজিটাল বিলবোর্ড ও ডিজিটাল টিভি স্ক্রিন ছিল না। হঠাৎ করে বিলবোর্ডের রঙিন তীব্র আলোর ঝলকানিতে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন গাড়ির চালকরা। রাস্তায় মোড়ে মোড়ে ইউটার্ন করার সময় রঙিন আলোতে গাড়ির সামনে কোনো কিছু দেখতে পান না চালকরা। চলন্ত গাড়ির সামনে সব কিছু এলোমেলো মনে হয়। এতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বেশিরভাগ চালকই।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে ডিজিটাল বিলবোর্ড ও রঙিন টিভি স্ক্রিন নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে একাধিক পথচারী বলেন, আ জ ম নাছির উদ্দিন মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার প্রথম বছরই বিলবোর্ড অপসারণের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিলেও মেয়াদের শেষ দিকে এসে সর্বনাশটা করে গেছেন। তিনিই ডিজিটাল বিলবোর্ড বসানোর অনুমতি দিয়ে নগরীর সৌন্দর্যকে ম্নান করে দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, এক বছর আগে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আখরুজ্জামান ফ্লাইওভারের সাড়ে ৬ কিলোমিটারজুড়ে বিলবোর্ড বসানোর অনুমতি দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। প্রতিবছর দেড় কোটি টাকার চুক্তিমূল্যে এ কাজটি দেওয়া হয়েছে ট্রেড ম্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা, ফ্লাইওভারের উপরের-নিচ অংশের পরিচ্ছন্নতা বজায় ও বাগানের পরিচর্যা করার শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছিল ওই চুক্তিতে।
ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠান ট্রেড ম্যাক্সের স্বত্ত্বাধিকারী হেলাল আহমেদ বলেন, ‘এক বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে আখরুজ্জামান ফ্লাইওভারে বিলবোর্ড বসানোর কাজ নেওয়া হয়েছে। কোনো টেন্ডার হয়নি। এ ফ্লাইওভারে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটারজুড়ে বিজ্ঞাপন বোর্ড বসানোর কাজ প্রক্রিয়াধীন। ইতিমধ্যে প্রায় শতাধিক বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড বসানোর কাজ শেষ। বাকিগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদামতো বসানো হবে।’
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিন হোসাইন বলেন, ‘সম্প্রতি আবারও বিলবোর্ডের কবলে পড়েছে নগরবাসী। যত্রতত্র এসব ডিজিটাল বিলবোর্ড ও ডিজিটাল টিভিস্ক্রিন লাগানোটা খুবই দুঃখজনক। ডিজিটাল বিলবোর্ড থাকবে, কিন্তু সেটা কোন্ জায়গায় হবে, সাইনবোর্ড কত সাইজের হবে এবং তার দায়িত্বপ্রাপ্ত করা থাকছেন তার সবকিছু নিয়মনীতিতে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো নিয়মও মানা হচ্ছে না। শুধু ব্যবসা করার মানসিকতা ম্লান করে দিচ্ছে সবুজ নগরকে।’
তিনি বলেন, পরিকল্পিত নগরায়নে অযাচিত ডিজিটাল বিলবোর্ড বাধার সৃষ্টি করবে। ব্যস্ততম সড়কে অতিরিক্ত উজ্জ্বলতার জন্য দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে প্রতিমুহূর্তে।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মুফিদুল আলম বলেন, ‘এক বছর আগে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয় ফ্লাইওভারে বিজ্ঞাপন বসানোর দরপত্রের কাজ। প্রতি বছরে দেড় কোটি টাকা ট্যাক্স দেওয়ার বিনিময়ে এ কাজটি ট্রেড ম্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এটি কোনো টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয়নি। সরাসরি কাজটি দেওয়া হয়। সাবেক মেয়র নাছির সাহেবের আমলে এ চুক্তিটি করা হয়।’
সিপি