ফেসবুক ও ইউটিউবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে পরিচিতি পাওয়া ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের চিকিৎসাকে ‘অপচিকিৎসা’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে সেটা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিটিলিস (এফডিএসআর)। ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের ভিডিও কনটেন্টগুলোকে ‘বিভ্রান্তিকর ও অবৈজ্ঞানিক’ অভিহিত করে সংস্থাটি বলেছে, অনলাইন থেকে ওইসব কনটেন্ট না সরালে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ‘বিষোদগারের’ জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে ডা. জাহাঙ্গীর কবিরকে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. জাহাঙ্গীর কবীর। শুধু ফেসবুকেই বর্তমানে তার ফলোয়ার ২০ লাখেরও বেশি।
এফডিএসআরের মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আপনার (ডা. জাহাঙ্গীর) সাম্প্রতিক সময়ের কর্মকাণ্ড আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় এই পত্র লিখতে হচ্ছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন চিকিৎসক হিসেবে আমাদের যেমন নানারকম বিশেষ অধিকার রয়েছে তেমনি দায়িত্বও রয়েছে। এফডিএসআর মনে করে কোনও চিকিৎসকেরও দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করার ও অসত্য বলার অধিকার নাই এবং এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি জীবনধারা পরিবর্তন ও এর মাধ্যমে নানারকম ক্রনিক রোগের চিকিৎসা করছেন বলে দাবি করেন। এজন্য অনলাইন ও অফলাইনে মানুষকে সুস্থ জীবন গড়ে তোলার জন্য লাইফস্টাইল বা জীবনধারা পরিবর্তনের পরামর্শ দিচ্ছেন। এসবই আপাত দৃষ্টিতে চমৎকার কাজ। কিন্তু আপনার মনে রাখতে হবে আপনার পরামর্শ হতে হবে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সমর্থিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক। শুধু তাই নয় এই সকল পরামর্শ যাতে কারো ক্ষতির কারণ না হয় সেদিকেও আপনাকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘আপনি কিটো ডায়েটের পরামর্শ দিচ্ছেন। বিভিন্ন চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপশনকে হেয় করে মন্তব্য করছেন। টিকা নিয়ে ইম্যুনোলজি বিষয়ক ভুল বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি আপনার কোনও লেখায় বা বক্তব্যে আপনার সেবাগ্রহীতাদের কিটো ডায়েটের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনও লিখিত বা মৌখিক কাউন্সেলিং করেন না। ইনফর্মড কনসেন্ট নেন না। আপনি ডায়াবেটিক রোগী ও কিডনি রোগীকেও কিটো ডায়েটের পরামর্শ দিয়েছেন বলে আমরা জানি। এই ডায়েটের ফলে দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদী যেসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে সেটা নিয়ে আপনি কখনও রোগীদের অবগত করেন না। এটা ম্যালপ্র্যাকটিস। অথচ কিটো ডায়েট এর জন্য রোগীর ইনফর্মড কনসেন্ট নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই ডায়েটের ফলে হৃদরোগ বৃদ্ধি ও কিডনির ক্ষতি, মাংসপেশীর ক্ষতি, হাড়ের ক্ষতি সহ নানা রকম প্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।’
ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আপনি সম্প্রতি বলেছেন কোভিড ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে শরীরে অ্যান্টিবডি প্রবেশ করানো হয়। আরও বলেছেন ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাক্সিন দরকার। এরকম ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে আপনি আপনার অজ্ঞতাপ্রসূত পোস্ট মারফত কোটি কোটি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন যা জনবিরোধী কাজ। আপনার টিকা নিয়ে অজ্ঞতা দেশের চিকিৎসকদের মর্মাহত ও লজ্জিত করেছে। আপনার কোনও অধিকার নাই মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে ক্ষতি করার।’
চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র পোস্ট করে তাতে ওষুধের সংখ্যা নিয়ে ডা. জাহাঙ্গীর কটাক্ষ করেছেন জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘যে রোগীর হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি অসুখ আছে তার জন্য অনেকগুলি ওষুধ প্রয়োজন হতেই পারে। আপনি এটি নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যঙ্গ করেছেন। শুধু তাই নয় আপনি বলেছেন জীবনধারা বদলালে ওষুধ লাগে না। আর জীবনধারা ভালো না হলে ওষুধ কাজ করে না। এভাবে আপনি ওষুধের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন যা অসাধু কাজ ছাড়া কিছু না। আপনার কথা অনুযায়ী তাহলে লাইফস্টাইল না বদলালে কোলোস্টেরোল লোয়ারিং এজেন্ট কাজ করার কথা না। উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কাজ করার কথা না। সব ধরনের অ্যাকিউট অ্যাটাকে কোনও ওষুধ কাজে লাগার কথা না। এমনকি ভিটামিনও কাজ করার কথা না। বহু রোগী আছেন হাঁপানির যাদের জীবনধারার সঙ্গে তাদের শ্বাসকষ্টের সম্পর্ক নাই। আপনার কথা অনুযায়ী ইনহেলার ও অ্যালার্জির ওষুধও কাজ করার কথা না। তার মানে আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘রক্তকে অ্যাসিডিক করা বিষয়ে আপনার বক্তব্যের কোনও ভিত্তি নাই। আপনি লিখেছেন ডায়াবেটিসের ওষুধ কিডনি নষ্ট করে। আপনি একাধিকবার বলেছেন লাইফস্টাইল মডিফিকেশন করলে ওষুধ লাগবে না। যে রোগের কারণের মধ্যে লাইফস্টাইল আছে সেখানে ওষুধের দরকার নাই। এরকম ভুল কথা বলা অন্যায় কারণ আপনি জানেন যে রোগের কারণ বা রোগের প্রভাবক দূর করলেই রোগ সেরে যায় না। শরীরের বন্ধু টিস্যু আছে যা একবার নস্ট হলে তা রিভার্স করা যায় না। আপনি নিজে কিটো ডায়েটের ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া নিয়ে মানুষকে অবগত করেন না কিন্তু চিকিৎসকরা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে রোগীদের বলে না, বিনাকারণে ইনসুলিন দেয় এসব একথা বলে বিষোদগার করেন।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনি নিয়মিত বিভিন্ন চিকিৎসা ও পরামর্শ দিচ্ছেন যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত রোগ নিরাময়ের পদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সামাজিক মাধ্যমে নানারকম ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর।’
ওই চিঠির শেষাংশে জানানো হয়, ‘অতএব, এই পত্রপ্রাপ্তির এক সপ্তাহের মধ্যে আপনি সকল মাধ্যম থেকে আপনার ভুল ও বিকৃত তথ্যাদি অপসারণ করবেন। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন। অন্যথায় আপনার বিরুদ্ধে দেশের আইন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।’