ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে চট্টগ্রামের যুবক ভয়ঙ্কর প্রতারণায়, শ্যালকসহ ধরা
অর্থ হাতানো হয় ই-মেইল ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে
চট্টগ্রামের যুবক ইন্টারনেটের ‘ডার্ক ওয়েব’ থেকে স্পর্শকাতর গোপন তথ্য কিনে নিয়ে ইমেইল হ্যাক করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থেকে শুরু করে বড় বড় প্রতারণার ঘটনা ঘটিয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। ওই যুবকের সঙ্গে আছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র।
ইন্টারনেটভিত্তিক এই চক্রটির মূল হোতা মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান ওরফে রনি। ৩৮ বছর বয়সী এই যুবকের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। তবে তিনি থাকেন ঢাকায়। তার শ্বশুরবাড়ি চাঁদপুরের মতলবে।
রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে এই চাঁদপুর থেকেই রনিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। রনির সঙ্গে একইসঙ্গে ধরা পড়ে রনির শ্যালক ও চক্রের অন্যতম প্রধান হোতা মাজহারুল ইসলাম ওরফে শাকিল (২৪)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, তিনটি মোবাইল ফোন, তিনটি সিম কার্ড ও একটি রাউটার জব্দ করা হয়েছে।
ইন্টারনেটের ‘ডার্ক ওয়েব’ থেকে তথ্য নিয়ে জার্মানভিত্তিক কার্গো কোম্পানির সার্ভারে ঢুকে ই-মেইল হ্যাক করে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার এক মামলায় ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডার্ক ওয়েব হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের একটি অংশ যা ডার্ক নেটে বিদ্যমান। উন্মুক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে এটি এক প্রকার লুকায়িত নেটওয়ার্ক। এতে প্রবেশ করতে নির্দিষ্ট সফটওয়্যার, কনফিগারেশন বা অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এই অংশে সাধারণ সার্চ ইঞ্জিন প্রবেশ করতে পারে না। ডার্ক ওয়েব বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ যেমন জালিয়াতি, ফিশিং ও স্ক্যাম, অবৈধ বাণিজ্য, বিতর্কিত পর্নোগ্রাফি ছাড়াও সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেও ব্যবহার করা হয়। তবে ডার্ক ওয়েব অনেক মানবকল্যাণমূলক কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে তথ্যের নির্ভুলতাও যাচাই করা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, এমএ আহসানুল বারী নামের এক ব্যবসায়ী জার্মানিতে অবস্থিত কারকন কার্গো লিমিটেডের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ও কারকন কার্গো কন্ট্রোল বিডির স্বত্বাধিকারী। সম্প্রতি তিনি গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন।এতে তিনি অভিযোগ করেন, কেউ সম্প্রতি তার মেইল আইডি হ্যাক করে জার্মানিতে অবস্থিত মূল কোম্পানির কাছে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে খরচ বাবদ ৪ হাজার ৮০০ ডলারের ডিমান্ড নোট পাঠিয়ে মেইল করেছে।
পরে মামলা তদন্তে ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, প্রতারক রনি ডার্ক ওয়েবের বিভিন্ন সাইট থেকে ই-মেইলের তথ্য সংগ্রহ করেন। ডার্ক ওয়েব থেকে এমএ আহসানুলের ই-মেইলের তথ্য পান। এই তথ্য দিয়ে তিনি কোম্পানির ই-মেইল অ্যাড্রেসে প্রবেশ করে জার্মানিতে অবস্থিত মূল কোম্পানির কাছে খরচ বাবদ ৪ হাজার ৮০০ ডলার চেয়ে মেইল করেন। মেইলে রনি প্রতারণা করে এম এ আহসানুলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য দিয়ে টাকা পাঠাতে অনুরোধ করেন জার্মানির কোম্পানিটিকে।
জানা গেছে, নতুন অ্যাকাউন্ট দেখে জার্মানি থেকে আবারও অ্যাকাউন্টটি কনফার্ম করার জন্য বলা হয়। রনি আবার কনফার্ম মেইল করেন। তারপর পাঠানো সব মেইল অ্যাকাউন্ট থেকে মুছে দেন। কোম্পানি তার দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরই মধ্যে এম এ আহসানুল বিষয়টি বুঝতে পেরে দ্রুত কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে। এমএ আহসানুলের মাধ্যমে জার্মানির ওই কোম্পানি প্রতারণার বিষয়টি জানতে পেরে সুইফট সিস্টেম থেকে লেনদেনটি স্থগিত করে দেয়।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ জানান, রনির নেতৃত্বাধীন প্রতারকচক্রটি ডার্কওয়েবের বিভিন্ন সাইট থেকে ই-মেইল এবং ভিসা, মাস্টারকার্ড, পেপালসহ বিভিন্ন ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে। এসব তথ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মেইল আইডি হ্যাক করে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে নিজেদের অ্যাকাউন্ট দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
তিনি জানান, ওই প্রতারকচক্র বিদেশিদের বিভিন্ন কার্ডের তথ্য দিয়েও ইউএসএ, ইউকে, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের পণ্য অনলাইনে অর্ডার করতো। অনলাইনে আইফোন, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, উন্নতমানের কসমেটিকস পণ্য অর্ডার করে তারা। কিছু কিছু পণ্য ইতোমধ্যে শিপমেন্টও হয়েছে। কিছু পণ্য শিপমেন্টের অপেক্ষায় রয়েছে— যার বাজারমূল্য ৪-৫ লাখ টাকা।
জানা গেছে, প্রতারকচক্রের মূলহোতা মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান রনির বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে হলেও তার জন্ম ঢাকার তেজগাঁওয়ে। রনি ২০০০-২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে এবং রানী মার্কা ডেউটিনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের কাজ করেন। পরে তিনি ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর তিনি অনলাইন ছাড়াও ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে পুরাতন কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি চকবাজার থেকে কসমেটিকস কিনে গাউছিয়া ও নিউমার্কেটে বিক্রি করতেন।
২০১৫ সালে রনি বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি চাঁদপুরের মতলবে শ্বশুরবাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পরে ২০১৯ সাল থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ঢাকার জুরাইন এলাকায় বসবাস করতে থাকেন এবং পুরাতন কম্পিউটার যন্ত্রাংশ ক্রয়-বিক্রয় করতে থাকেন।
এ সময় হ্যাকারদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। হ্যাকিং সংক্রান্ত বিভিন্ন কৌশলও তিনি শিখে নেন। এ সময় তিনি হ্যাকারদের সঙ্গে অনলাইন প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন। অনলাইন প্রতারণার দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অন্য হ্যাকারের সঙ্গে রনিও গ্রেপ্তার হন। গত বছরের ১ আগস্ট জামিনে মুক্তি পেয়ে শ্যালক শাকিলকে নিয়ে আবার ই-মেইল এবং ভিসা, মাস্টারকার্ড, পেপালসহ বিভিন্ন ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ শুরু করেন। এছাড়া আইফোনসহ, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, উন্নতমানের কসমেটিকস পণ্য প্রতারণামূলকভাবে অর্ডার করে প্রতারণা করে আসছিলেন।
সিপি