রেলওয়েতে শুরুটা খালাসি হিসেবে, এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি শামসুর রহমানকে। রেলে আধিপত্য জমিয়ে তিনি এখন ঊর্ধ্বতন উপ সহকারী প্রকৌশলী। সেইসঙ্গে কমিশন বাণিজ্য, কাজ না করে বিল উত্তোলন, ঠিকমতো অফিস না করাসহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেচে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ঊর্ধ্বতন উপ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতির চার বছরেও তিনি দায়িত্ব বুঝে নেননি। এছাড়া দপ্তরের প্রতি কাজের ‘কমিশন’ তাকে দিয়ে দিতে হয় বলেও অভিযোগ তোলেন ঠিকাদাররা। শামসুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লেও দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নেননি কোনো ব্যবস্থা। তাকে বদলি করা হলেও ‘টাকার জোরে’ সেই বদলিও ঠেকিয়ে দেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ আছে, দপ্তর তালাবদ্ধ রেখে ভেতরে গোপনকক্ষে পছন্দের ঠিকাদারদের নিয়ে চলে বৈঠক, মদপান। সেইসঙ্গে এক নারী রেলকর্মীকে রাত ১০টা পর্যন্ত অফিস করতে বাধ্য করা হয়।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সেতু) হিসেবে পদোন্নতির চার বছরেও দায়িত্ব বুঝে নেননি শামসুর রহমান। দাপ্তরিক চিঠি এবং কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশের পরও তিনি দায়িত্ব বুঝে নেননি। এরপর শামসুর রহমানকে ২০২০ সালে ঢাকার রাজবাড়ি বদলি করা হয়। কিন্তু ‘টাকার জোরে’ তিনি বদলি বাতিল করান বলে গুঞ্জন ওঠে।
এরপর ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর সহকারী প্রকৌশলী সেতু (পূর্ব) আকবর আহম্মেদ ফেরদৌসের সঙ্গে তার হাতাহাতির ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ঠিকাদার জাকির হোসেনকে লাকসাম স্টেশনের পুরাতন বিপুল পরিমাণের লোহা টুকরো ও পিস করে চট্টগ্রামের গোডাউন জমা দিতে শামসুর রহমান স্বাক্ষরিত আদেশে রোডপাস ইস্যু করা হয়। কিন্তু এসব লোহা চট্টগ্রামের গোডাউনে জমা না করে, কুমিল্লায় খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়। শামসুর রহমান ও ঠিকাদার এসব রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেলেও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়।
এদিকে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে কদমতলীর রেল সেতু কারখানার ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সেতু) শামসুর রহমানের দপ্তর।
রেলের একাধিক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনীর মুহুরীগঞ্জ স্টেশনের ব্রিজ (১৮৫ নম্বর) মেরামতের জন্য ৩০ লাখ টাকার দরপত্র দেয় রেলওয়ে। কিন্তু সেই কাজ কৌশলে পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে কম টাকায় করিয়ে নেন শামসুর। পরে সেই টাকা ঠিকাদারসহ ভাগ-বাটোয়ারা করে নিজেদের পকেটে ভরেন। এ বিষয়ে অভিযোগ গেলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এছাড়া খুলশীর ঝাউতলা নলকূপ ও পরিদর্শন দপ্তরে (সেতু) ১টি নতুন গোডাউন নির্মাণ ও পুরাতন গোডাউন মেরামতে ব্যয় ধরা হয় যথাক্রমে ৫১ লাখ ও ১০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে টিন দিয়ে মেরামত করা হয় গোডাউনটি আর দপ্তরটিতে শুধুমাত্র রংয়ের কাজ করা হয়। ঠিকাদারদের অভিযোগ, এসব মেরামত কাজে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। আর বাকি টাকা ভাগাভাগি করে ফেলেছেন শামসুর ও ঠিকাদার। তদন্ত করলেই সত্যতা পাওয়া যাবে।
ঠিকাদাররা অভিযোগ করে আরও জানান, মুহুরীগঞ্জের আরেকটি ব্রিজ (১১৯-এ) মেরামতে ১২ লাখ টাকার কাজ পছন্দের ঠিকাদারকে দেন শামসুর। সেই কাজে প্রায় ১০ শতাংশ কমিশন গেছে শামসুরের পকেটে। তার এসব কুকর্মের সঙ্গে অফিস সহকারী সাঈদও জড়িত বলে অভিযোগ তোলেন তারা।
অফিস সহকারী সাঈদ বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে বাইরের কাজে ব্যস্ত স্যার (ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী)। তিনি কয়েক দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেন, তাই সময় পান না।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-সহকারী প্রকৌশলী শামসুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি। আর নারীকর্মীর ডিউটি ও দায়িত্ব বুঝে না নেওয়া দপ্তরের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
অফিসে না থাকা ও রাষ্ট্রীয় মালামাল বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘লাইনে থাকতে হয় তাই অফিসে থাকা সম্ভব হয় না। আর রাষ্ট্রীয় মালামাল কুমিল্লায় বিক্রি বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি।’
শামসুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে প্রকৌশলী সেতু (পূর্ব) আবরার হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি ফোন রিসিভ করে প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে সংযোগ কেটে দেন। পরে মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মিলেনি।
এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিয়া বলেন, ‘লোকবল সংকটের কারণে তিন দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শামসুর রহমানকে।’
শামসুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে দ্রুত তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন আবু জাফর মিয়া।
ডিজে