ঝুঁকির যাত্রা/ টিকিটের যাত্রী ট্রেনের ছাদে চড়ে ফিরছে বাড়ি

ছাদে উঠা নিষেধ, তবুও থামছে না টিকিট বিক্রি

নাজমুন নাহার গার্মেন্টস শ্রমিক। গন্তব্য বরিশাল। স্বজনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পাড়ি দিচ্ছেন দূরপাল্লার পথ। চাঁদপুরগামী স্পেশাল ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়েন বগিতে। টিকিট কেটেছেন তবে সিট পাননি। ভেতরে দাঁড়ানোর জো নেই। মানুষের ভীড় যেন গিজগিজ করছে। সিটের কাঙ্খিত যাত্রী এলে জায়গা ছেড়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে উঠে পড়েন ছাদে। প্রচন্ড গরমে হাঁসফাস বাঁচতে ঝুঁকি নিয়েই বাড়ি ফিরতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছেন না। উদ্দেশ্য একটাই বাড়ি ফিরতে হবে।

নাজমুন নাহারের মতো অসংখ্য মানুষ উঠেছেন ট্রেনের ছাদে। সকলেই বাড়ি ফিরবে। মিনিটদুয়েক পর কর্তব্যরত প্রহরী এসে তাগাদা দিচ্ছেন ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য। প্রহরীর সাথে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়ে নাজমুন নাহার বলেন, ‘ভেতরেও জায়গা নেই, ছাদেও যেতে দিবেন না তাহলে টিকিট দিলেন ক্যান?’ ছাদে থাকা যাত্রীরা হাত উঁচিয়ে টিকিট দেখাচ্ছেন। সকলের হাতেই টিকিট অথচ ভেতরে তিল পরিমাণ ঠাঁই নেই। সকলেই সমস্বরে বলে উঠেন, জীবনের মায়া কি আমাদের নেই! আমরা কি বাড়ি যাবো না? টিকিট কেটেই বাড়ি যাচ্ছি, বিনা পয়সায় নয়।

এদিকে বারবার কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে ট্রেনের ছাদ থেকে না নামলে ট্রেন ছাড়া হবে না। যাত্রীদের কেউই ঘোষণা যেন শুনছেনই না। ধীরে ধীরে ট্রেনের ছাদেও যাত্রীদের ভীড় বাড়ছে। কর্তব্যরত পুলিশ-প্রহরী সকলেই একে একে এসে বারবার এসে সতর্ক করে পুনরায় ফিরে গেছেন। ট্রেন ছাড়ার কথা ৩.২০ মিনিটে কিন্তু সেই ট্রেন ছেড়েছে ৪.৩৫ মিনিটে। ছাদে বরং আরও দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে। ট্রেনের ভিতরে-বাহিরে থাকা সকল যাত্রীর কাছেই টিকিট রয়েছে। কেউ কেউ স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়ে আগপাছ না ভেবেই উঠে পড়েছেন ছাদে।

সিটের কাঙ্খিত যাত্রী এলে জায়গা ছেড়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে উঠে পড়েন ছাদে।
সিটের কাঙ্খিত যাত্রী এলে জায়গা ছেড়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে উঠে পড়েন ছাদে।

ঈদে ঘরমুখো মানুষের বাড়ি ফেরার সহজলভ্য যাত্রা ট্রেনে। তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও পাড়ি দেন গন্তব্যের দিকে। এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেনের ছাদে উঠতে নিষেধ করলেও থেমে নেই টিকিট বিক্রি। ঘোষণাকক্ষ থেকে ঘোষণা এলেও ছাদ থেকে নিচে নামার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই যাত্রীদের। আসন সীমিত থাকার পরেও টিকিট বিক্রি হচ্ছে বলেই যাত্রীদের ভীড় বাড়ছে এমনটাই দাবি অনেক যাত্রীর।

দুপুরে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ঈদযাত্রা উপলক্ষে যারা অগ্রিম টিকিট পেয়েছিল তারা নির্ধারিত আসনে বসে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আর যারা টিকিট পাননি, তাদের মধ্যে অনেকে ট্রেনের ভেতরে উঠেছেন। আবার অনেকে ট্রেনের ছাদে। দুপুর ৩টার মহানগর গোধূলী ও বিকেল ৫টার সোনারবাংলা ট্রেনে তিলধারণের ঠাঁই নেই। এ ছাড়া চাঁদপুরগামী স্পেশাল ট্রেন ছাড়াও মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনেও উপচেপড়া ভিড়।

ট্রেনের ভিতরে-বাহিরে থাকা সকল যাত্রীর কাছেই টিকিট রয়েছে।
ট্রেনের ভিতরে-বাহিরে থাকা সকল যাত্রীর কাছেই টিকিট রয়েছে।

সোনার বাংলা ট্রেনে ঢাকাগামী যাত্রী রাশেদুল আলম বলেন, ‘চারটি অগ্রিম টিকিট কেটেছি। প্রতিবারই দেখি ঈদের সময় উপচেপড়া ভিড়। এ সময় চরম ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বাড়ি যান। ট্রেন বাড়ানো দরকার না হয় সাধারণ যাত্রীদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। সবারই তো পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদ করতে মন চায়।’

জিআরপি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রেল কর্তৃপক্ষ বারবার বলেন ট্রেনের ছাদে যেন যাত্রী না থাকে। কিন্তু সকলের কাছেই টিকিট আছে। কতজনকে নামাতে পারি বলেন। যদি অসাবধানতাবশত কেউ উপর থেকে পড়ে যায় তখন তো আপনারাও ছাড়বেন না। বড় বড় হেডলাইনে নিউজ হবে। ট্রেন বাড়ছে না আবার টিকিটও বিক্রি হচ্ছে। যাত্রীদের দোষ কীভাবে দেবো। নামাতে গেলেই বলে আমাদের জায়গা করে দেন আমরা সেভাবেই যাবো। এমন অবস্থা যেন জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।’

রেলওয়ে পুলিশ সুপার নওরোজ হোসেন তালুকদার চট্টগ্রাম প্রতিদিন বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে চারগুণ টিকিট বিক্রি হলে এ মানুষের দোষ কী? আমরাও ২৪ ঘন্টা নজরদারিতে রেখেছি। বাধা দিয়ে তো লাভ হয় না। একদিকে নামালে অন্যদিকে উঠে পড়ে। সামাল দেয়া চাট্টিখানি কথা না। টিকিট ছাড়া কেউ উঠে না। সকলের হাতেই টিকিট। তখন আর কিছু করার থাকে আমাদের?’

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সীমিত সম্পদের মধ্যে এতো মানুষের চাহিদা পূরণ করা কঠিন। তবে আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। গত ৫ বছরে যা হয়েছে স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও তা আগে হয়নি।’

ট্রেনের ছাদে উঠতে নিষেধ করলেও থেমে নেই টিকিট বিক্রি।
ট্রেনের ছাদে উঠতে নিষেধ করলেও থেমে নেই টিকিট বিক্রি।

ছাদে যাত্রী উঠা ঠেকাতে টিকিট বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টিকিট না নিলেও তারা (যাত্রীরা) ছাদে উঠবে এটা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। আমরাও যথেষ্ট নজর রাখি। এখানে যারা ছাদে উঠে তাদের বেশিরভাগই স্ট্যান্ডিং টিকিট করেছে। আগে থেকে টিকিট কাটে নাই। আমরা স্বীকার করছি, আসন সীমিত থাকার পরেও শুধুমাত্র যাত্রীদের অনুরোধে ১০ শতাংশ টিকিট বিক্রি করা হয় যারা ভেতরে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে।’

তবে সরজমিনে দেখা যায়, স্ট্যান্ডিং টিকিট ছাড়াও অগ্রিম টিকিট করেও অনেকেই আসন পায়নি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠেন যাত্রীরা।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, নতুন ট্রেন না এলেও এবারের ঈদযাত্রায় রেলের পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৬০ কোচ। যা ঈদ স্পেশাল ট্রেন ছাড়াও আন্তঃনগর, মেইল ও এক্সপ্রেস ট্রেনের বরাদ্দকৃত ঘাটতি কোচ হিসেবে সংযোজন হয়েছে। রেলের পূর্বাঞ্চল তথা চট্টগ্রাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-ঢাকা ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে আন্তঃনগর ট্রেনগুলো সবসময় কোচ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। প্রতিবছরের মতো ২২টি কোচ দিয়ে দুটি ঈদ স্পেশাল ট্রেন চালু হলেও চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুরগামী এসব স্পেশাল ট্রেনে বাড়ি ফেরার তাগিদে অনেকেই নিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি। এছাড়াও প্রতিটি ট্রেনে ১৬টি বগি থাকলেও এবার চারটি বগি বাড়ানো হয়েছে। প্রতি বগিতে ৬০ জন করে যাত্রী বসতে পারেন। সেই হিসাবে ট্রেনে ১২ শতাধিক যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন ২০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হবে।

যারা টিকিট পেয়েছেন তারা সিটে বসে যেতে পারলেও অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে করে বাড়ি ফিরতে উদগ্রীব। রেলস্টেশনে কথা হয় চাঁদপুরগামী যাত্রী শরিফুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আজকে অফিসের শেষ কর্মদিবস ছিল। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। অগ্রিম টিকিটের জন্য স্টেশনে এসেছিলাম। কিন্তু পাইনি। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য অনেক টাকা খরচ করে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। তাই যেকোনোভাবে ট্রেনে বাড়ি যেতে হবে।’

চট্টগ্রাম রেলওয়ের স্টেশন ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের চাপ থাকাটা স্বাভাবিক। নির্ধারিত আসনের চেয়ে কয়েকগুণ যাত্রী ঈদের সময় বাড়ি যান। তাদের পরিবহনে আমরা হিমশিম খাই। তারপরও যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি পৌঁছাতে প্রাণপণ চেষ্টা করি। নিয়মিত ১০টির পাশাপাশি এবার ঈদ উপলক্ষে দুই জোড়া স্পেশাল ট্রেন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও চারটি করে বগি যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিদিন ২০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হবে।’

রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ম্যানেজার প্রকৌশলী বোরহান উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কেবল ঈদ এলেই যাত্রীদের চাপ বাড়ে। অন্যসময় তো ফাঁকাই থাকে। নতুন ট্রেন এসে লাভ কী! নতুন ট্রেন না এলেও বাড়তি বগি, কোচ লাগানো হয় যা একটা ট্রেনের চেয়েও কম না। তবে এটা আমাদের যাত্রীদের তুলনায় অপ্রতুল।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!