ট্রায়াল রানের ওপর ঝুলছে চট্টগ্রাম বন্দরে ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিটের ভবিষ্যৎ

অগ্রাধিকার নয়, ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে নোঙ্গর করবে ভারতের ট্রানজিট পণ্যবাহী জাহাজ। ভারত-বাংলাদেশ ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির আওতায় চারটি কনটেইনার এই প্রথম ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটি হচ্ছে প্রথম ট্রায়াল রান।

বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ সিডিউল অনুযায়ী পোর্ট ডিউজ, পাইলটেজ ফি, অন্যান্য আনুষঙ্গিক চার্জ দিতে হবে ভারতকে।

ওমর ফারুক বলেন, ভারতীয় কনটেইনারও কাস্টমসের রাজস্ব প্রদান করতে হবে। সড়কপথ পরিবহনের ক্ষেত্রে সওজ মাশুল আদায় করতে পারবে। শিপিং এজেন্ট, সিএন্ডএফ এজেন্ট, কার্গো পরিবহন এজেন্টরা আয়ের সুযোগ পাবে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করে পণ্য যাবে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরায়। এজন্য গত বৃহস্পতিবার কলকাতা বন্দর থেকে রওনা হয়েছে একটি জাহাজ, মঙ্গলবার সকাল আটটায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে নোঙর করবে। সেখান থেকে ১০টায় চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ১ জেটিতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে জাহাজটির। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু করছে ভারত।

জানা গেছে, বন্দর থেকে খালাস করা কনটেইনার সড়কপথে আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে প্রবেশ করবে। তবে বাংলাদেশের জন্য সড়ক ব্যবহারের জন্য এখনও কোনো চার্জ নির্ধারণ করা হয়নি। পরীক্ষামূলক চালানে বিনা চার্জেই যাচ্ছে পণ্য। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পণ্য খালাস না হওয়ায় কোনো কাস্টমস ফিও নেই, শুধু অপারেশনাল কিছু চার্জ দিতে হবে।

সূত্রমতে, ভারত-বাংলাদেশ ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির আওতায় প্রথমবারের মতো ২২১টি কনটেইনার নিয়ে গত বৃহস্পতিবার কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর থেকে যাত্রা করে এমভি সেঁজুতি। তবে এর মধ্যে চারটি কনটেইনার রড ও ডালের চালান রয়েছে ভারতের। এ চার কনটেইনারের মধ্যে দুই কনটেইনার রড ত্রিপুরার জিরানিয়ার এসএম করপোরেশনের। বাকি দুই কনটেইনার ডাল যাবে আসামের জেইন প্রতিষ্ঠানের কাছে। বাকি কনটেইনারগুলো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের।

এ চালানের মাধ্যমেই বাংলাদেশের বন্দর ও সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পরিবহনের প্রথম পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে। যদিও আমদানি করা পণ্য বাংলাদেশের ভেতর খালাস হবে না— এ যুক্তিতে গ্যাট চুক্তি স্বাক্ষরকারী হিসেবে কাস্টমস ফি আরোপ করা যাবে না। আর আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য পরিবহনে ভারতকে সুবিধা দেওয়া হলেও বাংলাদেশ এ ধরনের সুবিধা পায়নি।

চুক্তি অনুযায়ী, ভারতীয় পণ্য ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাত ধরনের মাশুল আদায় করবে। এর মধ্যে প্রতি চালানের ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা মাশুল ১০০ টাকা, এসকর্ট মাশুল ৫০ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক মাশুল ১০০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি কনটেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং বিধি অনুযায়ী ইলেকট্রিক সিল ও লক মাশুল প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক সিল ও লক লাগানোর চার্জ হিসেবে প্রথম ৪৮ ঘণ্টার জন্য ৭০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ৪৮ ঘণ্টা অতিক্রম করলে বাড়তি প্রতি ঘণ্টার জন্য ৫০ টাকা হারে চার্জ আরোপ করা হবে।

যদিও প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ প্রতি টন পণ্যের জন্য ১০ টাকা হারে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি আদায়ের প্রস্তাব করেছিল, তবে খরচ অনেক বেড়ে যাবে বলে ওই প্রস্তাবে আপত্তি জানায় ভারত। এর পরিবর্তে প্রতি চালানে মাত্র ৩০ টাকা ডকুমেন্ট প্রসেসিং চার্জ নির্ধারণ করা হয়।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি কনটেইনার রাখায় স্থানীয়রা চার দিন বিনামূল্যে রাখার সুযোগ পায়। ভারতের আমদানিকারকদের জন্য এ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ দিন। যদিও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বাংলাদেশ ও ভারতের আমদানিকারকদের জন্য একই। অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত হারেই চার্জ গুণতে হবে ভারতকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহারের জন্য এখনও কোনো চার্জ নির্ধারণ করা হয়নি। যদিও গত ডিসেম্বরে টনপ্রতি পণ্যের জন্য প্রতি কিলোমিটারে দুই টাকা ১০ পয়সা হারে ফি আরোপের প্রস্তাব করা হয়।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতীয় ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য কোন্ কোন্ রুটে চলবে, ফি কত হতে পারে এর একটি ধারণাপত্র তৈরি করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দর পর্যন্ত পথের জন্য ১৫ টনের একটি ট্রাককে ১৫ হাজার টাকা ফি দিতে হবে ভারতকে। তবে ভারতের সঙ্গে সচিব পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ প্রস্তাবে সম্মত হয়নি দেশটি। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়, বন্দর ব্যবহারের জন্য ফি দেওয়া হলে আবার সড়ক ব্যবহারের জন্য ফি কেন দিতে হবে?

ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের চার্জ আরোপ করা হবে— তা নির্ধারণে ২০১১ সালে গঠন করা হয়েছিল কোর কমিটি। ২০১২ সালে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ওই কমিটি। ট্রানজিট ফি নির্ধারণে আট ধরনের চার্জ বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে। এগুলো হলো ব্যবহারকারী চার্জ, অবকাঠামো উন্নয়ন, কনজেশন (সড়কে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ), বায়ু ও শব্দদূষণ, প্রশাসনিক, নিরাপত্তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক চার্জ। ব্যবহারকারী চার্জের মধ্যে আবার অবকাঠামো উন্নয়নে জমি অধিগ্রহণ ও সড়ক ব্যবহারের ফলে ক্ষয়ক্ষতির চার্জ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ৪ দশমিক ২৫২৮ টাকা চার্জ আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছিল। অর্থাৎ কোর কমিটির সুপারিশের চেয়েও অর্ধেক হার প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। সে প্রস্তাবেও সম্মত হয়নি ভারত। তবে পরীক্ষামূলক চলাচল শেষে দুই দেশের সচিব পর্যায়ে বৈঠকে সড়ক ব্যবহার ফি নিয়ে আলোচনা করা হবে। তখন বোঝা যাবে সড়ক ব্যবহারে কত চার্জ আরোপ করা হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, যদি কলকাতা-চট্টগ্রাম বন্দর নৌরুটে খরচ কম হয়, তাহলে তারা নিয়মিত ট্রানজিট নেবে। এটা আমাদের জন্য টেস্ট কেস। এটা এখন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এর মূল বিষয় হলো কত সময়ের মধ্যে, কত খরচে পণ্য পৌঁছানো হয় তা দেখা। এজন্য ট্রায়াল চলছে। এক্ষেত্রে বন্দরের প্রচলিত হ্যান্ডলিং চার্জ নেওয়া হবে। আর কাস্টমসও নির্ধারিত হারে বিভিন্ন মাশুল আদায় করবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!