টাকা দিলে সবই মেলে চসিকের করোনা টিকাদান কেন্দ্রে, সুনাম বাঁচাতে সরে গেল রেড ক্রিসেন্ট
অনিয়মের পাহাড় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে
করোনার টিকা নিয়ে চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের ‘দুর্নাম’ থেকে নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচাতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) আওতাধীন দুটি টিকাদান কেন্দ্র থেকে নিজেদের স্বেচ্ছাসেবকদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। টিকাদান কেন্দ্র দুটি হল সাম্প্রতিককালে বিতর্কিত সদরঘাটের সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতাল এবং কালুরঘাট মোহরা এলাকার সাফা মোতালেব মাতৃসদন হাসপাতাল।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে করোনার টিকা নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহু অভিযোগ উঠেছে। এর আগেও হাজার টাকার বিনিময়ে চসিকের কর্মীদের টিকাদানের অভিযোগ ছিল। সেসব নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে জনমনে। তবে অনিয়মের এসব ঘটনার নেপথ্যে চসিকেরই এক শীর্ষ কর্মকর্তা জড়িত— সরাসরি প্রমাণ না মিললেও এমন গুঞ্জন ভাসছে সবখানেই। মূলত তার প্রশ্রয়েই এসব অপকর্ম ঘটছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
এদিকে সর্বশেষ সদরঘাটের সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতাল এবং কালুরঘাট মোহরা এলাকার সাফা মোতালেব মাতৃসদন হাসপাতাল কেন্দ্র দুটিতে ‘তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অনিয়মের কারণে সৃষ্ট ভোগান্তির’ দায় থেকে বাঁচতে নিরূপায় হয়ে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম যুব বিভাগের দায়িত্বশীলরা। তবে এর আগে এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন ও চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আক্তারকে অভিযোগ জানিয়েছিলেন তারা। এর পরেও সমস্যা সমাধান না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান যুব রেড ক্রিসেন্টের নেতারা।
এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতাল কেন্দ্রে টাকার বিনিময়ে টিকা দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের যে অভিযোগ বেশ কিছুদিন ধরেই উঠছিল, তা আরও জোরালো হলো। তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ শুরু থেকে সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসলেও এই মুহূর্তে তাদের অবস্থান জানা সম্ভব হয়নি।

রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম যুব প্রধান ইফতেখার হোসেন ইমু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দুটি টিকাদান কেন্দ্র থেকে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এসব কেন্দ্রে কর্মচারীদের ব্যাপক অনিয়মের কারণে টিকাদান কেন্দ্রে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছিল। আর সাধারণ মানুষ এজন্য আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদেরও দায়ী ভাবছিল। আমরা বারবার এসব বিষয়ে সবাইকে বলেছি। কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি। তাই আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা যাতে সেই বদনামের ভাগীদার না হয় সেজন্য আমরা স্বেচ্ছাসেবকদের সরিয়ে নিয়েছি।’
টিকাদান কেন্দ্রে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক ধরনের অনিয়ম হয়। যেমন এসএমএস দেওয়ায় অনিয়ম হয়। তিন মাস আগে রেজিস্ট্রেশন করেও অনেকে এসএমএস পান না। আবার অনেকে এখন রেজিস্ট্রেশন করে এক্ষুনি সাথে সাথে এসএমএস ও টিকা পেয়ে যাচ্ছেন টাকার বিনিময়ে। তাছাড়া দীর্ঘ লাইনে থাকা মানুষদের পাশ কাটিয়ে ভিন্ন পথে মানুষ ঢোকানো হয়, ফলে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। অনেক সময় দেখা যায় এসব লোকজন কয়েকজনের তালিকা এনে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে এন্ট্রি করার নির্দেশও দেয়। বলা হয়, তাদের আত্মীয়। পরে জানলাম এ সবকিছুই করা হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বিনিময়ে।’
এসরের সাথে কারা জড়িত এমন প্রশ্নের উত্তরে ইমু বলেন, ‘তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা এসব করে। বিশেষ করে দারোয়ান, ড্রাইভার, আয়া, পিয়ন, কম্পিউটারম্যান এরা বেশি করে। যেমন সাফা মোতালেবে কম্পিউটার অপারেটর আব্দুল্লাহ আল মনির নামে একজন আছে, চসিক জেনারেল হাসপাতালে মহিউদ্দিন ও চন্দন নামে দুজন। এরাই সিন্ডিকেট করে এসব করে।’
এসব বিষয়ে কাউকে অভিযোগ করেছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইমু বলেন, ‘আমরা সিভিল সার্জনকে জানিয়েছিলাম আগে। উনি বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা উনাকেও জানিয়েছি।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আক্তার চৌধুরীকেও এসব বিষয় জানানো হয়েছিল জানিয়ে ইমু বলেন, ‘আমরা প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকেও জানিয়েছি। যতবারই উনাকে বলেছি উনি বলেছেন— ‘দেখি’। বিষয়টা দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।’
‘আমরা বলতেছি, কিন্তু আমাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি’— হতাশার সুরে বলেন ইমু।
এসব কারণে রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের হেনস্তার শিকারও হতে হয়েছিল জানিয়ে ইমু বলেন, ‘কিছুদিন আগে বাইরে অপেক্ষমান মানুষ গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়। তখন ভয়ে চসিকের কর্মীরা পালিয়ে যার যার রুমে ঢুকে আত্মগোপন করে। কিন্তু আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পালায়নি। আর মানুষ এসে তাদেরই জিম্মি করে। পরে ৯৯৯-এ কল করে পুলিশ আনিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়। ওইদিন রাত ৯টা পর্যন্ত তারা কাজ করেছে। সবাইকে টিকা দিয়ে তাদের সেখান থেকে যেতে হয়েছে।’
‘আমরা তো ভাই মানুষের ভালোর জন্য কাজ করি। এই কাজের জন্য আমরা কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই না। কিন্তু অন্যদের অন্যায়ের কারণে আমরা বিতর্কের বোঝা কেন নেবো। এজন্যই আমরা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে শুধু এই দুই কেন্দ্রের ক্ষেত্রেই এই সিদ্ধান্ত আমাদের। বাকি সব কেন্দ্রে আমরা আগের মত কাজ করছি। আর এর মধ্যে ছাফা মোতালেব কেন্দ্রে থেকে আমাদের সাথে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা বলছে তারা কথা বলবে’— আক্ষেপের সুরে বলেন যুব রেড ক্রিসেন্টের এই নেতা।
তবে এই বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কারও বক্তব্য জানা যায়নি। চসিকের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শহীদুল আলম এবং প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আক্তার চৌধুরীর মোবাইলে কয়েক দফায় কল করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখানে আসলে আমাদের সরাসরি কিছু করার নেই। এটা চসিকের বিষয়। তবু এই অভিযোগগুলো যতবারই এসেছে আমি বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছি। এটাও জানাবো। চসিকও কোথাও কোথাও মামলা করেছে, বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে আমাদের হয়তো আরও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু করার সুযোগ হতো।’
প্রসঙ্গত, রাজধানীসহ সারাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকরা।
সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সকল জেলার সিভিল সার্জন ও সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকদের অন্তর্ভূক্ত করার জন্য অফিসিয়াল চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
এর আগে গত ৯ আগস্ট বাসায় গিয়ে টিকা দেওয়ার ঘটনায়ও জড়ায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নাম। চসিকের টিকাদান কেন্দ্র মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজ কোভিড ভ্যাকসিন কেন্দ্র থেকে এক স্বাস্থ্যকর্মীর যোগসাজশে বাসায় গিয়ে টিকা দেওয়ার ওই কার্যক্রম চলছিল। বাসায় গিয়ে টিকা দেওয়ার জন্য চসিকের ওই স্বাস্থ্যকর্মী বিষু দে টিকাপ্রতি ‘কন্ট্রাক্টে’ নিচ্ছিলেন এক হাজার টাকা। এ ঘটনায় খুলশী থানায় একটি মামলা হয়েছে।
গত ১০ জুলাই চট্টগ্রাম প্রতিদিনে ‘চট্টগ্রামে ভিআইপি টিকার রমরমা ব্যবসা চসিকের হাসপাতালেই, রয়েছে দুই নাম্বার টিকাও’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটের কালিবাড়ি রোডে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত জেনারেল হাসপাতালে করোনা টিকার অবৈধ বাণিজ্য চলছে প্রকাশ্যেই। টিকাপ্রতি সেখানে নেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ১৪০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যৌথ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে টিকার এই কারবার। এজন্য তারা আশ্রয় নিচ্ছে অভিনব সব কৌশলের। অন্যদিকে চসিকের এই হাসপাতালে কর্মরত একাধিক কর্মী এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকলেও হাসপাতালেরই একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন, টিকাদানে নিয়োজিত দুজন কর্মী ছাড়া বাকিদের দেওয়া টিকা পুরোটাই ‘দুই নাম্বার’।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে জানা যায়, সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালে করোনার দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে আসা প্রার্থীদের প্রথমে টিকার সংকট দেখিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে এদের মধ্যে যারা বিশেষ এজেন্ট বা কর্মকর্তা-কর্মচারীর রেফারেন্সে আসেন তারা টিকা পান। আবার যারা টিকার জন্য পীড়াপিড়ি করেন, তাদের কৌশলে বশে এনে টাকার বিনিময়ে টিকা ‘ম্যানেজ’ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
অন্যদিকে গত ৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী গলিতে করোনার সরকারি টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজের’ জমজমাট ব্যবসা নিয়ে ‘চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে করোনার টিকা বেচে কথিত সুইপার, দিনে আয় ১ লাখ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনে। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘অস্থায়ী কর্মচারী’ হিসেবে এলাকায় পরিচয় দেওয়া এক লোক নগরীর হাজারী গলির একটি ঘরে নিজ হাতেই দিচ্ছেন করোনা টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজ’। তবে চসিক সূত্রে জানা গেছে, বলয় আদৌ চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মী নন।
এআরটি/সিপি