টাইগার সাকিবে কাবুলিওয়ালা কুপোকাত

সাকিবের ব্যাটে ফিফটির পর বল হাতেও ৫ উইকেট

টাইগার সাকিব আল হাসান। নিজের চেহারায় হাসি লেগেই থাকে, হাসান পুরো দলকে সেই সাথে বাংলাদেশকে। বিশ্বকাপে এবারের আসরে তৃতীয়বারের ম্যাচ সেরা পুরস্কার হাতে নেয়ার পর উপস্থাপক জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাটে-বলে অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতার কারণ কী? সাকিব আল হাসান চমৎকার এক হাসি দিয়ে জানালেন, বিশ্বকাপের আগে থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে আসছিলেন নিজেকে মেলে ধরার জন্য। উপস্থাপক আবার যখন জিজ্ঞেস করলেন, পরিশ্রম সবাই করে, কিন্তু আপনার সফলতার কাহিনি কী? এবার সাকিব যোগ করলেন, ‘পরিশ্রমের সাথে ভাগ্য একীভূত হয়েছে’।

টাইগার সাকিবে কাবুলিওয়ালা কুপোকাত 1
সাকিবের আরও একটি উইকেট। ব্যাট হাতে চমৎকার জুটি গড়া মুশফিকের অভিনন্দন।

বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার নিজের দখলে অনেকদিন ধরে। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে যেই সাকিবকে দেখা যাচ্ছে সেরকম আগে কখনো দেখা যায়নি। আগে কখনো বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে ওয়ানডে ম্যাচে টেস্টের আবহ নিয়ে আসতেও দেখা যায়নি। বিষয়টি পরিষ্কার করে বলি, ম্যাচটা কি টেস্ট না কি ওয়ানডে, ধন্দে পড়ে যেতে হলো ক্ষণিকের জন্য। আফগানিস্তান ইনিংসের তখন ৩১তম ওভার। উইকেটের পেছনে স্লিপে দাঁড়ানো একজন। উইকেটের পেছনে না হোক, সামনের দিকে তাকিয়ে যে একটু স্বস্তি খুঁজবেন ব্যাটসম্যান, সে উপায়টুকুও নেই। সিলি মিড অফেও হেলমেট-ইনার পেড পড়ে যে ওত পেতে আছেন আরেকজন! ইনিংসের অর্ধেক পার হয়ে যাওয়ার পর এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়াটা একটু বিরলই বটে। সাকিব আল হাসানের সৌজন্যে সেটিও দেখা হয়ে গেল। ওয়ানডেতে এমন ফিল্ডিং প্রতিপক্ষের দুর্বলতাকে চোখে আঙুল তুলে দেওয়া। সোমবার আফগানদের সেই লজ্জাই দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। এই ম্যাচের আগে আফগান অধিনায়ক গুলবদিন নাইব যে ‘বাংলাদেশকে হালকাভাবে নিচ্ছি না’—এমন গা জ্বলুনি কথা শুনিয়েছিলেন। নাইবের পর নবী যোগ করে বলেছিলেন, ‘আমরা তো ডুবছিই, বাংলাদেশকে নিয়েই ডুবব।’ বাংলাদেশ হালকা নয়, আফগানরা ভালো করেই বুঝল। সেই ভারে নিজেরাই ডুবে গেল আরও অতলে।

সাকিবকে কেউ তেতিয়ে দিলে কতো ভয়ংকর হতে পারেন সেটি ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে অনেকবার। সেটিই যেন আবার নতুন করে টের পেল আফগানিস্তান। ব্যাটে বলে সমান উজ্জ্বল সাকিব। নাহ্, বোলিংয়েই ঔজ্জ্বল্য ছড়ালেন বেশি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ৫ উইকেট নিলেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে মোট ১ হাজার রান পূর্ণ হলো। আর এবারের আসরে আবারও ফিরলেন শীর্ষ রানের মালিকের তালিকায়। বিশ্বকাপ ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই ম্যাচে ৫০ রান ও ৫ উইকেটের ডাবল কীর্তিও হলো।

টাইগার সাকিবে কাবুলিওয়ালা কুপোকাত 2
আফগানদের হারিয়ে শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ঠেলে লাল-সবুজরা উঠে গেছে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচে। সাত ম্যাচে টাইগার পয়েন্ট এখন ৭। শীর্ষে থাকা- নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত আর ইংল্যান্ড যদি পা পেছলায়, ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজেদের শেষ দুই ম্যাচে যদি জয় আসে, সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার দলের জন্য।

এক সাকিব থেকেই আফগানদের দূরত্ব কত দূর—সেটাই বুঝিয়ে দিল বাংলাদেশ। সাকিব নিজে ম্যাচ শেষে মুশফিকের কথা বলেছেন। দলের বিপদের সময় নেমে প্রায় শেষ পর্যন্ত থেকে ৮৩ রানের ইনিংসটির কারণে তিনিও বাহবা পাবেন। মুশফিক শেষ পর্যন্ত ছিলেন বলেই বাংলাদেশ ৭ উইকেটে ২৬২ রান তুলতে পেরেছে। সাউদাম্পটনের এ মাঠে এই স্কোর আরও বড়। বাংলাদেশ সেটাই প্রমাণ করে দিল শেষ পর্যন্ত, আফগানদের ২০০ রানে অলআউট করে দিয়ে।

ব্যাট হাতে প্রতি ম্যাচে রান পেয়েছেন বলেই কি না, সোমবার বোলার সাকিবের মাহাত্ম্যই বড় হয়ে দেখা দিল। ১০ ওভার পার হয়ে গেছে, অথচ মাশরাফি তখনো স্পিনত্রয়ীর কাউকেই আক্রমণে আনেননি। আফগানিস্তানের স্কোরবোর্ডেও ততক্ষণে উঠে গেছে ৪৮ রান। অস্বস্তি তখন একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করেছে। একাদশ ওভারে আক্রমণে এসে অস্বস্তির মেঘ প্রথম দূর করলেন সাকিবই। রহমত শাহকে মিড অনে তামিম ইকবালের ক্যাচ বানিয়ে জানান দিয়ে রাখলেন, বাংলাদেশ নয়, রোজ ভোল্টের ম্যাচে ডুববে শুধু আফগানিস্তানই।

টাইগার সাকিবে কাবুলিওয়ালা কুপোকাত 3
সাকিবের হাত থেকে বের হচ্ছে আরেকটি গোলা। এভাবে একে একে পাঁচ আফগান ব্যাটসম্যানদের ইতি টানেন তিনি।

তবে সাকিব নিজের বোলার সত্তার সেরাটা দেখালেন ইনিংসের ২৯তম ও নিজের পঞ্চম ওভারে। মাত্র দুই উইকেট হারিয়েই ১০০ পার করে ফেলেছে আফগানিস্তান, বাংলাদেশের সমর্থকদের কপালে আবারও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। শর্ট কভারে দুজন ফিল্ডার রেখে গুলবদিনের জন্য টোপ পাতলেন সাকিব, প্রথম বলেই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিলেন আফগান অধিনায়ক। লিটন দাসকে সুযোগ করে দিলেন, তাঁর ‘অন্যায়’ আউটের প্রায় হুবহু রিপ্লে করে প্রতিশোধ নেওয়ার। লিটন নিলেন পরিষ্কার ক্যাচ, তৃতীয় আম্পায়ার-সফট সিগনাল কিছুই লাগল না।

সাকিবের ক্ষুধা তখনো মেটেনি। ওই ওভারে তিন বলে মধ্যে সাকিবের দ্বিতীয় আঘাত। আর্মবলটা বুঝতে পারলেন না মোহাম্মদ নবী। বোল্ড! এক ওভার বিরতি নিয়ে নিজের সপ্তম ওভারে আসগর আফগানকেও ডিপ মিড উইকেটে বানালেন সাব্বির রহমানের ক্যাচ। ৮ রানে তখন সাকিবের নামের পাশে ৪ উইকেট। এমন অনন্য একটা অর্জন উদযাপন করা উচিত, এমনটা ভেবেই কি না, দুই বল পর আবারো আঘাত হানলেন সাকিব। উইকেটে পড়ে হালকা ভেতরে ঢুকে যাওয়া বলের গতিপথ বুঝতে না পেরে বোকা বনলেন মোহাম্মদ নবী, আফগানিস্তানের জয়ের আশাও তখন নিভুনিভু।

মিটমিট করে জ্বলতে থাকা আফগান আশার প্রদীপে একটু একটু করে সলতে দিচ্ছিল সামিউল্লাহ শেনওয়ারি- নজিবুল্লাহ জাদরানের ৮ম উইকেট জুটি। মাত্র ৪৫ বলে ৫৬ রান তুলে ভয় দেখাচ্ছিলেন দুজনে। নজিবুল্লাহকে নিজের ৫ম শিকার বানিয়ে সে ভয়ও দূর করেছেন সাকিব। আজ শুধু ৫ উইকেট পেয়েছেন বলে নয়, প্রতিটা উইকেটই একেকটা বাঁক বদলের সাক্ষী ছিল যেন।

এর আগে ৭ উইকেটে ২৬২ রানের পুঁজি গড়তে পারে বাংলাদেশ। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় টাইগাররা। ইনিংসের ৪ ওভার পেরোতেই আউট লিটন দাস। দলের রান তখন মাত্র ২৩। যদিও ক্যাচটা বিতর্কিত ছিল। বলটা মনে হচ্ছিল, মাটিতে লেগেছে। টিভি আম্পায়ার আলিম দার কয়েকবার রিপ্লে টেনে টেনে দেখলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আউটের সিদ্ধান্তই দিলেন। মুজিব উর রহমানের শিকার হয়ে সাজঘরে ফেরেন লিটন। শর্ট কভারে হাসমতউল্লাহ শহীদি ক্যাচটা নেয়ার পরও লিটন ক্রিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আলিম দারও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না ক্যাচটা আসলে মাটিতে লেগেছে কিনা। একবার মনে হচ্ছিল, বলের নিচে আঙুল আছে। আরেক দিক থেকে মনে হচ্ছিল, মাটিতে বলের ছোঁয়া লেগেছে। ভাগ্যটা লিটনের বিপক্ষেই গেছে।

টাইগার সাকিবে কাবুলিওয়ালা কুপোকাত 4
ফিফটির পথে মুশফিকের একটি স্কুপ শট। শেষ পর্যন্ত তার ৮৩ রানের ইনিংসেই ২৬২ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ

অথচ লিটনের শুরুটা হয়েছিল বেশ ভালোই। মূলত ওপেনিং জুটিতে তিনিই ভালো খেলছিলেন। ১৭ বলে ২ বাউন্ডারিতে ডান হাতি এই ব্যাটসম্যান করেন ১৬ রান। ২৩ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ৬১ বলে ৫১ রানের জুটি তামিম ইকবাল আর সাকিব আল হাসানের। ১ উইকেটে ৭৪ রানে পৌঁছে যাওয়া টাইগাররা ১৫তম ওভারের শেষ বলে এসে তামিমকে হারিয়ে বসে। মোহাম্মদ নবীর বলটি ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে বোল্ড হন টাইগার ওপেনার, ৫৩ বলে ৪ বাউন্ডারিতে তামিম করেন ৩৬ রান। পরের ওভারে রশিদ খানের এলবিডব্লিউয়ের আবেদনে আবারও আঙুল তুলে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। এবার সাকিব রিভিউ নিয়ে জিতে যান। বল দেখা যায় স্ট্যাম্পের উপর দিয়ে চলে যেত।

তৃতীয় উইকেটে ৬১ রানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়েন সাকিব-মুশফিক। সাকিব একবার রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেলেও ৩০তম ওভারে এসে বাঁচতে পারেননি। মুজিব উর রহমানের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরেছেন তিনি। ৬৯ বলে গড়া সাকিবের ৫১ রানের ধৈর্যশীল ইনিংসটিতে ছিল মাত্র একটি বাউন্ডারির মার। মুজিবের পরের ওভারে আবারও ঝলক। এবার তিনি ফিরিয়ে দেন ওপেনিং থেকে মিডল অর্ডারে আসা সৌম্য সরকারকে। এলবিডব্লিউ হওয়ার আগে সৌম্য করেন মাত্র ৩ রান। ১৫১ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন ফের বিপদে বাংলাদেশ।

এরই মধ্যে পায়ের কাফে টান পড়ে নতুন ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহর। তিনি তখন মাত্র ৩ রানে। টাইগার সমর্থকরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। তবে মাহমুদউল্লাহ ওই ব্যথা নিয়েই ব্যাটিং চালিয়ে গেছেন। পঞ্চম উইকেটে মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ যোগ করেন ৫৬ রান। ৩৮ বলে ২ বাউন্ডারিতে ২৭ রান করে মাহমুদউল্লাহ গুলবাদিন নাইবের শিকার হন।

এমন উত্থান পতনের মধ্যে একটা প্রান্ত ধরে দলকে টেনে নিয়ে গেছেন মুশফিক। ষষ্ঠ উইকেটে মোসাদ্দেক হোসেনকে নিয়ে ৩৩ বলে ৪৪ রানের জুটি তার। সেঞ্চুরির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ইনিংসের ৪৯তম ওভারে এসে দৌলত জাদরানের বলে মারতে গিয়ে ক্যাচ হয়ে যান মুশফিক। ৮৭ বলে ৪ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় তখন তিনি ৮৩ রানে। এরপর মোসাদ্দেক শেষের কাজটা করে দিয়েছেন। ২৪ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ৩৫ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে একদম শেষ বলে আউট হয়েছেন ডান হাতি এই ব্যাটসম্যান।

আফগানিস্তানের পক্ষে মুজিব উর রহমান ৩টি আর গুলবাদিন নাইব নিয়েছেন ২টি উইকেট।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!