টমটমের ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে হাজার কোটি টাকা লুটপাট

গাড়ির দাম ৮৫ হাজার, লাইসেন্সের দাম পৌনে ২ লাখ

টেম্পো-ট্যাক্সি এবং রিক্সার যুগ পার করে অভ্যন্তরীণ সড়কপথে যোগাযোগের জনপ্রিয় বাহন হয়ে উঠেছে টমটম বা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা। বছরদশেক ধরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ব্যাটারিচালিত এই তিন চাকার যান নিয়ে এখন চলছে সিন্ডিকেটের অসৎ তৎপরতা। কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ এই গাড়িতে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণামূলক লাইসেন্স বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা। এমনও দেখা গেছে গাড়ির মূল্য যেখানে ৮৫ হাজার টাকা, সেখানে চক্রটি লাইসেন্স দেওয়ার নামে প্রতিটি গাড়ি থেকে মাথাপিছু পকেটে ভরেছে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ছাড়া ব্যাটারিচালিত এই তিন চাকার যানের লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার কারোরই নেই। তবু বেআইনিভাবে নিজেদের অর্থায়নে নাম্বার প্লেট তৈরি করেছে একাধিক কর্তৃপক্ষ। কথিত ‘বৈধতা’ দেওয়ার আশ্বাসে এসব নাম্বার প্লেট তথা লাইসেন্স প্লেট সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ হাজার অটোরিক্সায়। আর এর বিনিময়ে প্রতিটি লাইসেন্সের পেছনে কয়েক লাখ টাকা করে ২০ হাজার অটোরিক্সা থেকে কয়েকশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে কক্সবাজার পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন ঝিলংজা এবং অন্যান্য উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদকেন্দ্রিক গড়ে উঠা বেশ কিছু অসাধুচক্র।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার পৌরসভা শহরে এভাবে টমটম ও অটোরিক্সার অবৈধ লাইসেন্স বিক্রি করা হয়েছে দুই হাজার ৫০০টি। এর বাইরে এসব লাইসেন্স কপি করে আরও নতুন নতুন লাইসেন্স প্লেট বানিয়ে বিক্রি করা হয়েছে কমপক্ষে ৭ হাজার অটোরিক্সার মালিককে। এভাবে সদর ইউনিয়ন ঝিলংজায় কমপক্ষে আড়াই হাজার, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়াতে বিক্রি হয়েছে সাত হাজার, টেকনাফে সাড়ে তিন হাজার, চকরিয়াতে তিন হাজার, মহেশখালীতে পাঁচ হাজার, বৃহত্তর ঈদগাঁওতে ছয় হাজার এবং রামুতে দেড় হাজার। হাইওয়ে, ট্রাফিক, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং এসব গাড়ি বিক্রয়কারী ১৫টি প্রতিষ্ঠানের শো রুমে খোঁজ নিয়ে এ পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।

এদিকে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার অটোরিক্সাগুলোকে কথিত লাইসেন্স সরবরাহের ব্যাপারে জানতে চাইলে পৌরসভা বলছে, ছয় হাজার টাকার বিনিময়ে এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। গাড়ির মালিকেরা কেন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে এসব লাইসেন্স কিনেছে— সেটা তাদের জানা নেই।

কিন্তু এসব লাইসেন্স কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে এবং তা কতটুকু বৈধ— এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি কর ও লাইসেন্স শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল হক।

অন্যদিকে সদর ইউনিয়ন ঝিলংজায় অটোরিক্সার লাইসেন্স সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান টিপু সুলতান জানান, তিনি ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরে কোনো লাইসেন্স দেননি। এর আগের চেয়ারম্যানরা এসব টমটম বা অটোরিক্সার অসংখ্য লাইসেন্স বিক্রি করেছে। যদিও এসব লাইসেন্স কোনো কাজে আসতো না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। হাইওয়ে পুলিশ এসব গাড়ি ধরে ফেলতো। তবে অন্যান্য ইউনিয়ন পরিষদগুলোর মধ্যে যেগুলোতে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা নেই, সেখানে ইউনিয়ন পরিষদগুলো লাইসেন্স বিক্রি করে সুবিধা করতে পারছে বলেও জানান তিনি।

যেভাবে বিক্রি হচ্ছে পৌনে ২ লাখ টাকার ভুয়া লাইসেন্স
জানা যায়, ব্যাটারিচালিত টমটম বা অটোরিক্সা মালক ও চালকদের বেশিরভাগই হতদরিদ্র, শিক্ষাবঞ্চিত এবং আইন সম্পর্কে অসচেতন। মূলত একেই পুঁজি করে একটি প্রতারকচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে কক্সবাজারে। চক্রটি সংশ্লিষ্ট একাধিক সরকারি কর্তৃপক্ষকেও প্রতারণার ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে। এই ফাঁদে পড়ে সেসব কর্তৃপক্ষও অটোরিক্সা বা টমটম মালিক চালকদের এসব লাইসেন্স নিতে বাধ্য করে। এখানেই শেষ নয়। প্রতারণার মূল অংশটি শুরু হয় মূলত এর পর। কথিত এসব লাইসেন্স ওই চক্রটিই নির্দিষ্ট মূল্য ছয় হাজার টাকা পরিশোধ করে আগেভাগেই কিনে ফেলে। পরবর্তীতে কেউ যখন বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হেনস্থার শিকার হন, তখন বাধ্য হয়ে চালক কিংবা মালিকরা পৌরসভা কার্যালয়ের দ্বারস্থ হন। সেখানেই প্রতারকদের জালে আটকা পড়েন চূড়ান্তভাবে। এভাবেই সেই ছয় হাজার টাকা দামের এসব অবৈধ লাইসেন্স এক লাখ ৭০ হাজার টাকায় কিনে গাড়ির পেছনে লাগিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন নিরীহ মালিক-চালকরা।

লাইসেন্স বিষয়ে কক্সবাজার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, ব্যাটারিচালিত তিন চাকার এসব যানবাহনের লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার বিআরটিএর। কিন্তু পৌরসভা বা অন্যান্যরা কিভাবে লাইসেন্স দিচ্ছে সেটি তারা জানেন না।

ওই কর্মকর্তারা বলেন, যারা লাইসেন্স দিচ্ছে, সেটা বেআইনিভাবেই দিচ্ছে। গাড়িগুলোর লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে এখনও কোনো নীতিমালা বা আইন সরকারের তরফ থেকে আসেনি। এ কারণে বিআরটিএও আপাতত লাইসেন্স দিতে পারছে না।

‘লাইসেন্স’-এর ভিত্তিতে অটোরিক্সা ধরপাকড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, গাড়িগুলো চলছে সম্পূর্ণভাবে মানবিক বিবেচনা থেকে। এগুলোর লাইসেন্স বলতে কোনো কিছুই নেই। আর যারা লাইসেন্স সরবরাহের নামে বিভিন্ন অপকর্ম করছে তাদের পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় আনা হবে। এখন যেসব অটোরিক্সা ধরপাকড় করা হচ্ছে সেগুলো শুধুমাত্র যানজট নিরসনের জন্য। এছাড়াও ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগবে বলে যে তথ্যটি স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে তা গুজব। এ ধরনের কোনো লাইসেন্সের কথা জেলা পুলিশের সমন্বয় সভায় আলোচনা আনা হয়নি। তবে চালকদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভদ্রতার সাথে যাত্রীসেবা দিতে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং না করে যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখতে বলা হয়েছে তাদের।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!