‘জালিয়াতি’ দুই কর্তার যোগসাজশে ২০ কোটি টাকা গেল ১০ প্রতারকের পকেটে

দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল

কক্সবাজার জেলার কলাতলী পৌরসভা এলাকায় দুই একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ও পিবিআই’র দপ্তর নির্মাণে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয় ২০১৮ সালে।

তখন উক্ত জমির ২০৩০৭ দাগের ৭৫ শতক জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তের পর ওই জায়গায় কারা বসবাস করেছিল ও দখলীয় অবকাঠামোসহ কোন মূলে সেখানকার প্রকৃত মালিকগণ দখলে রয়েছেন তা জানতে জরিপ চালায় পুলিশ ও জেলা প্রশাসন। সরেজমিনে জরিপের পর যৌথ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। সে প্রেক্ষিতে তৈরি করা হয় একটি ফিল্ডবুক জরিপও।

জরিপে জমির মালিক ও দখলদারদের নাম প্রকাশ করা হয়। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ দেয়ার সময় নেয়া হয় চরম জালিয়াতির আশ্রয়। আসল মালিকদের বঞ্চিত করে জেলা প্রশাসনের তৎকালীন দুইজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া মালিক সৃষ্টি করে ২০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেওয়া ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে একটি অভিযোগের পর তদন্তে নামে দুদক। আর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর দপ্তর এ ঘটনার অনুসন্ধান করছে।

জানা যায়, যাদের নাম ফিল্ডবুক জরিপে ছিল না তাদের জমি অধিগ্রহণের টাকা ও চেক দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের নামে জমি অধিগ্রহণের কোনো নোটিশও দেয়া হয়নি। জমির দখলে থাকা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ না দিতে তড়িঘড়ি করে একসঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রায় ১৭ কোটি টাকার চেক প্রদান করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে পৃথকভাবে আরও সাড়ে ৩ কোটি টাকা অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজার জেলার তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. শামীম হোসাইন ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে ভূমি অধিগ্রহণের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অর্থ না দিয়ে অভিযুক্তদের অধিগ্রহণের টাকা পাইয়ে দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে জানিয়েছেন দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা।

তবে এমন অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শেষ না হওয়ার আগে মন্তব্য করতে রাজি হননি কক্সবাজারের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার।

সেখানে পৃথকভাবে ২০ কোটি ৫২ লাখ ৪৭ হাজার ৩৫৬ টাকা দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৭ মে গঠিত আদালতে মামলা দায়ের করার পর তদন্তে ক্রমিক নম্বর অনুসারে ১ থেকে ১৬ জন ব্যক্তির নামের তালিকা করে প্রকাশ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। দুদক অনুসন্ধানে জানতে পারে, জেলা প্রশাসন থেকে নোটিশবিহীন ও প্রকৃত মালিক না হওয়া সত্ত্বেও ওই তালিকায় থাকা ব্যক্তিদেরই দেওয়া হয়েছিল ভূমি অধিগ্রহণের টাকা।

তালিকায় থাকা অভিযুক্তরা হলেন, মোহাম্মদ নাছির, মোহাম্মদ টিপু সুলতান, মো. গোলাম মওলা, একেএম শামীমুর রহমান, বেলায়েত হোসেন, জিনাত রেহেনা, মোহাম্মদ নুরুল হক, মোহাম্মদ ইদ্রিস, ফেরদৌস আক্তার পাপড়ি, শাওরিং জাহান চৌধুরী, এডভোকেট মো. নেজামুল হক ও মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। উক্ত তালিকায় একই ব্যক্তির নামে একাধিকবার অধিগ্রহণের টাকা উঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ ১০ শতক জায়গার আমমোক্তারনামা গ্রহণ করে চন্দ্রিমা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের কর্মকর্তা জিনাত রেহেনা। তিনি সিআইপি মো. ইদ্রিস মিয়ার স্ত্রী। সেখানে প্রথমবার তিনি ৪ দশমিক ৪১ শতক জায়গারি বিনিময়ে ১ কোটি ৫৬ লাখ ১ হাজার ৬৫৩ টাকা উত্তোলন করেন। পরে ৯ দশমিক শূন্য শতকের জায়গার বিপরীতে ১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০৩ টাকা দ্বিতীয়বার উত্তোলন করেন।

দুদক বলছে, জিনাত রেহেনা শুধুমাত্র অধিগ্রহণকৃত জায়গার আমমোক্তারনামা গ্রহিতা। যাচাই বাছাই না করে মো. আশরাফুল আফসার ও শামীম হোসাইন যোগসাজসে দ্রুততম সময়ে জিনাত রেহেনার নামেই ভূমি অধিগ্রহণের টাকা ছাড় করিয়ে নেন।

এছাড়া চন্দ্রিমা বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে নেয়া পৃথকভাবে ১০ শতক এবং ২৪ শতক জমির আমমোক্তারনামা গ্রহণ করে জেলাপ্রশাসনের তালিকায় থাকা ১ থেকে ১০ নম্বর ব্যক্তি। অথচ চন্দ্রিমা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড (০৪/২০১৮-১৯ এলএল মামলার মূলে) ভূমি অধিগ্রহণের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান নয়।

যেখানে আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ১০ দিন সময় লাগার কথা সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় চেক প্রদান করে প্রকৃত দখলীয় ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর অধিগ্রহণের টাকা দেওয়া হয়েছে চন্দ্রিমা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের পক্ষে জিনাত রেহেনাকে -এমনটাই জানিয়েছে দুদক।

দুদক আরও জানিয়েছে, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ একসঙ্গে প্রায় ১৭ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণের চেক প্রদান করার বিষয়ে আদালতে একটি মামলা দায়ের করার পর তদন্তের নির্দেশ দেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন। তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ সচিব শ্রাবন্তী রায়কে উক্ত মামলা তদন্ত করার দায়িত্ব দেন। তবে এতে অভিযুক্ত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসারকে সদস্য করা হয়।

এতে করে তদন্ত কমিটির প্রকৃত চিত্র আড়াল করেই জমা দেওয়া হয় তদন্ত প্রতিবেদন -এমনটাই জানিয়েছে দুদক।

২০১৯ সালের ভূমি অধিগ্রহণের বিপরীতে ১ থেকে ১০ নম্বর অভিযুক্তকে ৯টি চেকের মাধ্যমে ১১ দশমিক দুই দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। উক্ত ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের নিকট একটি অভিযোগ দায়ের করেন ১১ নম্বর অভিযুক্ত এডভোকেট মো. নেজামুল হক।

তার দায়ের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে গোপনে চেকটি প্রদান করে বলে উল্লেখ করেছে দুদক। এডভোকেট মো. নেজামুল হকের দেওয়া অভিযোগের পর অভিযুক্ত তালিকায় থাকা ১০ নম্বর ব্যক্তি মিজানুর রহমানকে সিন্ডিকেটে অর্ন্তভুক্ত করে উক্ত চেক এডভাইস ও স্কল দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

এডভোকেট নেজামুল হক নিজে অভিযুক্ত হওয়ার সত্ত্বেও ১-১০ অভিযুক্তকে বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করে জেলা প্রশাসনের বরাবরে। পরে তার সঙ্গে অভিযুক্ত সরকারি শীর্ষ দুই কর্মকর্তা আতাঁত করে পরে ওই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়। তাকে তার প্রাপ্য ক্ষতিপুরণ দিয়ে দেয়। এতে করে তিনি ৫ কোটি ২৪ লাখ ৯১ হাজার ৯৮৭ টাকা প্রাপ্ত হন।

মিজানুর রহমানকে দেওয়া ভূমি অধিগ্রহণের প্রাপ্ত টাকার বিনিময়ে ০৪/২০১৮-১৯ এলএ মামলার অধিগ্রহণকৃত অন্যান্য দাগের জমির অভিযোগ থেকে কক্সবাজার জেলাপ্রশাসকের নিকট দায়ের করার অভিযোগটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

অভিযোগটি প্রত্যাহার করায় সেখানে প্রকৃত দখলদার আলী মদনের ওয়ারিশ থেকে প্রাপ্ত আমমোক্তারনামার মূলে মালিক নাজিম উদ্দিনকে ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করা হয় বলে জানিয়েছে দুদক।

এদিকে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে তিন অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করে দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক)। ওইদিন বেলায়েদ হোসেন নামে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক হিসাবে থাকা ৫০ লাখ টাকা, এডভোকেট মো. নেজামুল হক হিসাবে থাকা ৬০ লাখ টাকা, চন্দ্রিমা বহুমুখী সমবায় সমিতির কর্তা জিনাত রেহেনার ২ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার বিষয়টি তদন্তাধীন আছে বলে মন্তব্য করেননি।

তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি এখন ওখানে নেই। আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ করা হয়েছে সেটা তদন্ত হোক। পরে দেখা যাবে।’

ভূমি অধিগ্রহণের কর্মকর্তা শামীম হোসেনকে পৃথকভাবে মুঠোফোনে কল করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে মোবাইলে এসএমএস দেয়ার পরও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর অনুসন্ধান কর্মকর্তা বলেন, ‘কলাতলীতে পিবিআই ও সিআইডি দপ্তরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের টাকা উত্তোলনের অনিয়মের তদন্ত চলমান রয়েছে। এখন কোনো কিছু বলতে পারব না। তদন্ত শেষ হলে জানতে পারবেন।’

উল্লেখ্য, কক্সবাজার কলাতলী পৌরসভা এলাকায় ঝিলংজা মৌজার বিএস ৫৭২ নম্বর খতিয়ানের বিএস ২০৩০৬ দাগ থেকে ১৯৯১ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ১৩/৯১-৯২ নম্বর মামলা মূলে ০.৮৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

মুআ/কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!