একসঙ্গে দুই সরকারি চাকরি করেন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক

সব জেনেও ৭ বছরে তিন দফা পদোন্নতি, তদন্তে দুদক

তথ্য গোপন, ভুয়া নাগরিকত্ব ও জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে একই ব্যক্তি একই বিভাগে দুই চাকরি করে আসছেন। ‘গুণধর’ এই ব্যক্তি হলেন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া। শুধু তাই নয়, অনিয়ম থাকার পরও তিনি পান তিন দফা পদোন্নতি। এসব অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৪ সালে ‘স্বাস্থ্য সহকারী’ পদে চাকরি নেন সুজন বড়ুয়া। সেই সময় তার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দেখান কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মরিচ্যাবাজার পাড়া। আর তখন তিনি বিমল বড়ুয়ার পুত্র। ওই পদে তিনি চাকরিও করেন প্রায় ৮ বছর। এই চাকরি থাকা অবস্থাতেই ২০১২ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে আবারও চাকরি নেন। ওই সময় তার ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বালুখালী উত্তর ঘুমঘুম গ্রাম।

এদিকে ২০১২ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ার ৮ নম্বর শর্ত অনুযায়ী রাঙ্গামাটি জেলায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে যোগদানের আগে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতিপত্র গ্রহণের বিধান থাকলেও তা মানেননি তিনি। একই সঙ্গে শর্ত ছিল নিয়োগপ্রাপ্তদের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। নতুন চাকরির জন্য বান্দরবানের ঠিকানা দেখালেও সুজন বড়ুয়া মূলত কক্সবাজারের উখিয়ার বাসিন্দা।

সূত্র বলছে, ২০১২ সালে পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে নতুন চাকরি যোগদানের পরই জালিয়াতির অভিযোগ উঠে সুজন বড়ুয়ার বিরুদ্ধে। এতে তার বিরুদ্ধে বিস্তারিত অভিযোগ উল্লেখ করে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পক্ষ থেকে একটি চিঠিও দেওয়া হয় রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে।

ওই চিঠিতে বলা হয়, তথ্য গোপন, ভুয়া নাগরিকত্ব ও জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে পার্বত্য অঞ্চল কোটায় চাকরি নেয় সুজন বড়ুয়া। নিজ বেতনে রাঙ্গামাটি জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকালে সুজন বড়ুয়া এক মারমা সম্প্রদায়ের এক নারী স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের চেষ্টাও বিষয়েও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ঘটনার পর রাঙামাটির রাজস্থলী থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ নিয়ে দ্রুত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বদলি হন। তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠলে সেখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ নিয়ে আবারও বদলি হন ফেনী জেলায়। ফেনী জেলায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগদান করার কিছুদিন যেতে না যেতেই তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তোলেন সেখানকার ছয়জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। ২০১৮ সালে ফেনী জেলা থেকে বদলি হয়ে আসেন চট্টগ্রামে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি পান সুজন বড়ুয়া।

দেখা গেছে, ২০১২ সালে শুরুতে উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, এরপর জেলা স্বাস্থ্য পরিদর্শক থেকে জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি পান। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক পদে কর্মরত রয়েছেন।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাঙ্গামাটি জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদটি দশম গ্রেডের, যা পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক নিয়োগ বা পদোন্নতির আওতার বাইরে। সারা দেশে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক পদোন্নতি বোর্ডের মাধ্যমে জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন কর্মকর্তারা। তবে এসব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে ভুয়া সনদে চাকরি নেওয়া সুজন বড়ুয়া রহস্যজনক উপায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একের পর এক পদোন্নতি পাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, কিভাবে এতো অভিযোগ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরও তার পদোন্নতি হয়?

জানা গেছে, চট্টগ্রামে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদটি দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তার পদ। অথচ সুজন বড়ুয়ার ব্যাচের (৫৪তম ব্যাচ) বেশিরভাগই এখনও স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত। ৫৩তম ব্যাচের ১৫০ জন স্বাস্থ্য সহকারীর এখনও পদোন্নতি হয়নি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে মিটিংয়ে আছি। পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।’

দুদক সূত্র বলছে, সম্প্রতি চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়ার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। এই বিভাগের এখনও অনেক কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তবে সুজন বড়ুয়ার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মুআ/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!