জার্মানিতে আওয়ামী লীগের সভায় এসে নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়লেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হওয়ার পরপরই স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি দল তার দিকে তেড়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্দশা ও দুর্নীতির অন্যতম কুশীলব হিসেবে সরাসরি তাকে দায়ী করেন। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে তিনি নীরবে সভাস্থল ছেড়ে যান।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর গত আগস্টে হাছান মাহমুদ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে বেলজিয়ামে চলে যান। এরপর এই প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধর এই সাবেক মন্ত্রীকে জনসমক্ষে দেখা গেল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়াও বিপুল টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) বেলা ২টায় জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে জার্মান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের প্রতিবাদ সভা ও বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে টেলিকনফারেন্সে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন সদ্য ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সভায় সভাপতিত্ব করেন জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজানুর হক খান এবং সঞ্চালনা করেন জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া ও সহসভাপতি নুরজাহান খান নুরী।
জানা গেছে, সম্ভাব্য জনরোষ এড়াতে সমাবেশ উপলক্ষে প্রচারিত পোস্টারে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের নাম রাখা হয়নি। গত আগস্ট থেকে তিনি বেলজিয়ামের নিজ বাড়িতে অবস্থান করলেও সভা উপলক্ষে জার্মানি আসেন।
জানা গেছে, সভায় ভারতের দিল্লিতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ফোনে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। পরে নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার কাছে দিকনির্দেশনা চাইলে পাল্টা প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা নির্দেশনা চাচ্ছিলে না? এটাই তোমাদের প্রতি আমার নির্দেশনা। পড়ে পড়ে আর মার খাওয়া যাবে না, দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে হবে, মুক্ত করতে হবে।’
‘আওয়ামী লীগকে আপনারাই ডুবিয়েছেন’
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সভাস্থলে পৌঁছার পর হাছান মাহমুদ কুশলবিনিময় করার একপর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় হাছান মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে কয়েকজন বলেন, ‘আপনি কোনো কথা বলবেন না। আপনার মতো কয়েকজন নেতার কারণে আওয়ামী লীগের আজকে এই দুরবস্থা। চুপচাপ গিয়ে মঞ্চে বসে থাকুন।’ সভায় উপস্থিত অন্য একজন সাবেক এই মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘কেন আপনি বেলজিয়াম থেকে জার্মানি এসেছেন? এখানে আপনার কাজ কী? আওয়ামী লীগকে আপনারাই ডুবিয়েছেন।’
বার্লিন থেকে যাওয়া এক নেতা হাছান মাহমুদের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনাদের লোভ আর দুর্নীতির কারণেই দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা আজকে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে। হুমকির মুখে আছে সবার জীবন। আহত নিহত নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর আপনি রাখেন নাই। যাকে ইচ্ছা তাকে দলে ঢুকিয়েছেন। আপনাদের দুর্নীতির কারণে দল আজ বিপর্যস্ত, দিশেহারা।’
জার্মান আওয়ামী লীগের এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাছান মাহমুদ এরপর মলিন মুখে মঞ্চে গিয়ে বসে ছিলেন। তাকে তেমন কোনো কথা বলতেও শুনিনি।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়লেও হাছান ভাই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নাই। তিনি চুপচাপ ছিলেন। পরে জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজানুর হক খাঁন এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তিনি ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে হাছান ভাইকে সরিয়ে এনে বিশেষ অতিথিদের টেবিলে বসান। অনুষ্ঠানে বাকি পুরোটা সময় হাছান ভাই সেই চেয়ারেই বসে থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনেন। একপর্যায়ে সভাপতির অনুরোধে মাইক হাতে বক্তব্য রাখার চেষ্টা করেন আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে।’
ওই নেতা বলেন, ‘সভা শেষে হাছান মাহমুদ জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নীরবেই সভাস্থল ছেড়ে চলে যান।’
এর আগে ইউরোপ আওয়ামী লীগের এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানিয়েছিলেন, হাছান মাহমুদ বেলজিয়াম থেকে একাধিকবার দিল্লিতে অবস্থানরত দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী তার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি আসতে চেয়েও অনুমতি পাননি।
ঢাকা থেকে জার্মানি যান ২৫ আগস্ট
আটক হওয়ার পরও হাছান মাহমুদ কিভাবে বাংলাদেশ ছাড়তে সক্ষম হলেন— এ নিয়ে গত কয়েকমাস ধরে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করে। এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতে আছেন— এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া গেলেও পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, গত ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় (বেলজিয়াম সময়) হাছান মাহমুদ নিরাপদে বেলজিয়ামে পৌঁছেছেন। বেলজিয়ামে তিনি লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট হাছান মাহমুদ বাংলাদেশ ছাড়েন। ২৬ আগস্ট রাতে তিনি জার্মান বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর ডুসেলডর্ফের একটি রেস্টুরেন্টে যান খাবার খেতে। সেখান থেকে বেলজিয়ামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বকুল এ সময় তাকে সঙ্গ দেন।
এর আগে ৪ আগস্ট রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ ছাড়েন। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বিমানবন্দর। তবে তার পরিবারের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকেন।
পুরনো ডেরা বেলজিয়াম
হাছান মাহমুদ দীর্ঘদিন বেলজিয়ামে বসবাস করেছেন। সেখানে তার ছোট ভাই স্থায়ীভাবেই থাকেন। দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯২ সালের দিকে প্রথম বেলজিয়াম যান হাছান মাহমুদ। সেখানে তিনি বেলজিয়ামের ব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস ও লিম্বুর্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনাও করেছেন। ২০০১ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে তার ভাগ্য খুলে যায়।
পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে হাছান মাহমুদের নির্দেশে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ ভিন্নমতের বহু সংবাদপত্র ও অনলাইন একাধিকবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত দেড় বছরে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। এজন্য প্রধানত হাছান মাহমুদকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৬৫তম স্থানে। গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।
সিপি