জাতির পিতার ছায়ায় চট্টগ্রাম কলেজে উঠে এলো বাংলাদেশের ইতিহাস

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে’— লেখক আহমদ ছফা এভাবেই লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার গল্প আর বাংলা নামের দেশের গর্জে উঠার গল্পই ছবিতে তুলে আনলো চট্টগ্রাম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষকদের প্রায় তিন বছরের প্রচেষ্টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুরু থেকে শেষ এবং বাংলাদেশ হয়ে উঠার ইতিহাস তুলে আনা হয় শিক্ষার্থীদের জন্য।

রোববার (১৫ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম কলেজ প্রাঙ্গনে ‘আলোকচিত্রে জাতির পিতার অবয়ব’ শীর্ষক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুজিবুল হক চৌধুরী। এ প্রদর্শনীর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর জসিম উদ্দিন খান। পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার মালেক মজুমদার। সার্বিক নির্দেশনা ও সহযোগিতায় ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম, তানিয়া শফি, প্রভাষক ফারহানা হোসেন, নাহিদ ফাতেমা, মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন প্রমুখ।

জাতির পিতার ছায়ায় চট্টগ্রাম কলেজে উঠে এলো বাংলাদেশের ইতিহাস 1

ছবির গল্পে স্থান পায় বঙ্গবন্ধুর পরিবার, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ইতিহাস, কিভাবে তিনি শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হলেন। ভাষা আন্দোলনের পরিণতি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ছবি, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৩ সালে জেল থেকে বেরিয়ে প্রথম প্রভাত ফেরীতে অংশ নেওয়ার ছবি, এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচন করার সময় সেই সময়ের বানানরীতিতে তৈরি করা একটা পোস্টার— যেখানেই শেখ মুজিবকে ‘সেক’ মুজিব হিসেবে লেখা হয়েছিল।

একে একে উঠে আসে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মন্ত্রিসভায় শপথগ্রহণের ছবি। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের পটভূমি দৈনিক ইত্তেফাকের রঙিন ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয়। সে সময় পত্রপত্রিকায় কোনো রঙিন ক্রোড়পত্র ছিল না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩৫ জন আসামিদের মধ্যে এক নম্বর আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখনও বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি। যুক্ত হয়েছে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পরে তোফায়েল আহমেদের বঙ্গবন্ধু উপাধি ঘোষণার ছবি।

আমাদের রাষ্ট্রের নাম কী হবে— এমন প্রশ্ন দেখা দিলে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ’। পৃথিবীর আর কোন দেশের নামের সাথে ‘দেশ’ শব্দ নেই।

জাতির পিতার ছায়ায় চট্টগ্রাম কলেজে উঠে এলো বাংলাদেশের ইতিহাস 2

এ প্রদর্শনীতে আরও ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার গল্প। তুলে আনা হয় দোসরা মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ঘটনা। ছিল ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের দলিল— ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো যে ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে রয়েছে অনেক বিতর্ক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা ঘোষণাপত্র যা রোকেয়া চৌধুরী নামের একজনের কাছে রয়েছে। তার প্রামাণ্য দলিল রয়েছে এই প্রদর্শনীতে।

প্রদর্শনীতে ছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার ছবি, সেই কালরাত্রির রাজসাক্ষী সাত বছরের মেয়ের স্বাতীর চোখে দেখা বর্ণনায় উঠে আসা সেই ঘটনার লেখা ডায়েরি আর নির্বিচারে মানুষকে মারার মর্মন্তুদ ছবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজাদ নামের এক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়, তার বুলেটবিদ্ধ সেই বইয়ের ছবিও স্থান পায় প্রদর্শনীতে। ছিল জীবন বাঁচানোর তাগিদে ভারতের শরণার্থী হয়ে যাওয়ার ছবি, প্রতিরোধ গড়ে তোলার ছবিও।

এখানে স্থান পেয়েছে রণাঙ্গন থেকে প্রিয়জনের পাঠানো ১৬টি চিঠি যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষণাপত্রের ছবি, শপথ গ্রহণের ছবি। আছে হাজার বছর পিছনে যাওয়ার সেই দিন ১৪ ডিসেম্বর শহীদ হওয়া সকল বুদ্ধিজীবীর নাম।

রয়েছে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৬ ডিসেম্বরের প্রতিচিত্র। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি যেমন তাতে স্থান পায়, তেমনি আছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, অপরাজেয় বাংলা, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণের ছবি, বাংলাদেশকে পূনর্গঠনের জন্য বিদেশিদের সাথে মতবিনিময় ছবি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ১৯৭৫ সালের সেই ভয়াবহ ১৫ আগস্ট এখানে এসে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুরু থেকে শেষ আলোড়িত ঘটনা এই প্রদর্শনীতে স্থান পায়।

এ প্রসঙ্গে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর জসিম উদ্দিন খান বলেন, ‘এ আয়োজনের জন্য কৃতজ্ঞতা অধ্যক্ষ মহোদয়কে। উনার অনুপ্রেরণা এবং আমার বিভাগের সহকর্মী আনোয়ার মালেক মজুমদারের সার্বিক সহযোগিতায় দুর্লভ কাজটি করা সম্পন্ন হয়েছে। এখানে অনেকগুলো ছবি আছে ইতিপূর্বে হয়তো অনেকেই দেখিনি। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তারা এই ছবিগুলো দেখলে ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানবে। বাড়বে জানার পরিধি।’

সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার মালেক মজুমদার বলেন, ‘ইতিহাস পড়ার চেয়েও দেখে জানার আগ্রহ বেশি শিক্ষার্থীদের। তাই আমাদের এই আয়োজন। গত বছর একাত্তরের চিঠি নিয়ে আমাদের আয়োজন ছিল। এ প্রদর্শনীতে শিক্ষার্থীদের থেকে অভূতপূর্ব সাড়াও পেয়েছি। তারা জানতে চায় আর আমাদের কাজ তাদের জানানো। সেই কাজটিই আমরা করেছি।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!