জনতায় এস আলমের ১০ হাজার কোটির বেআইনি ঋণ অবশেষে খেলাপি

মূলধনেরও ৪২০ গুণ বেশি টাকা বের করে নেওয়া হয়

চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ এস আলমকে কোনো বিধিবিধান না মেনেই জনতা ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। অথচ গত জুন পর্যন্ত খোদ জনতা ব্যাংকের নিজেদের পরিশোধিত মূলধনই ছিল মাত্র ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। এমন অবস্থায়ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শীর্ষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় জনতা ব্যাংক এস আলম গ্রুপ যে বিপুল অংকের ঋণ দিয়েছিল, সেটা ছিল ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৪২০ শতাংশ। আমদানির নামে নেওয়া এই বিপুল অংকের টাকার প্রায় পুরোটাই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৫৭ শতাংশই এস আলম গ্রুপসহ সাতটি কোম্পানির হাতে। বাকি ছয়টি কোম্পানির মধ্যে অ্যানটেক্সের রয়েছে ৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট গ্রুপের ১ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, রতনপুর গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা এবং রিমেক্স ফুটওয়্যারের ১ হাজার ৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে।

জানা গেছে, জনতা ব্যাংক বছরের পর বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ‘অনুমোদন’ নিয়ে এস আলমের নেওয়া টাকা পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে কৌশলে ‘নিয়মিত’ বলে দেখাচ্ছিল। সদ্য পদত্যাগী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সর্বশেষ আবার ওই ঋণ পুনঃতফসিল ও নবায়নে বাড়ানোর সব বন্দোবস্তই করে রেখেছিলেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এস আলমের নেওয়া ঋণ পুনঃতফসিল ও নবায়নের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। ফলে এস আলমের নেওয়া পুরো টাকাই এখন খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, জনতা ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ ঋণ হিসেবে বের করে নিয়েছে মোট ৯ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। নীতিমালা অনুসারে একক কোনো গ্রুপকে মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হিসেবে ফান্ডেড সর্বোচ্চ ৩৪৭ কোটি ১০ লাখ এবং নন-ফান্ডেড সর্বোচ্চ ২৩১ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেওয়া যাবে। ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড সবমিলিয়েও সর্বোচ্চ দেওয়া যাবে ৫৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

কিন্তু জনতা ব্যাংক কোনো বিধিবিধানের ধার না ধেরেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শীর্ষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলমের গ্রুপের হাতে তুলে দেয় ৯ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। যা ছিল পুরো জনতা ব্যাংকেরই মোট পরিশোধিত মূলধনের ৪১৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে ফান্ডেড ঋণে পরিণত হয়েছে ৮ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। নন-ফান্ডেড রয়েছে বাকি ৮১৬ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ‘অনুমোদন’ নিয়ে নিয়ে বছরের পর বছর ঋণ নবায়নের মেয়াদ একের পর এক বাড়িয়ে যাচ্ছিল এস আলম গ্রুপ। সর্বশেষ গত ২৫ জুন শেখ হাসিনা সরকারের শীর্ষ মহলের ইঙ্গিতে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আবার ঋণ পুনঃতফসিল ও নবায়নের বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

জানা গেছে, পর্ষদের ওই সভায় এস আলম রিফাইন্ড সুগার, এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল, গ্লোবাল ট্রেডিং, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল এবং এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল—এই ছয় প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা চার বছরের জন্য পুনঃতপশিলের অনুমোদন দেওয়া হয়। একই দিন ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার চলতি মূলধন হিসেবে নেওয়া ঋণসীমা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নবায়ন প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় বলা হয়, এতো বিপুল টাকা ঋণ নেওয়া হলেও গ্রাহকের ঋণপত্র দায় সময়মতো পরিশোধ করেনি এস আলম গ্রুপ। ব্যাংক থেকে দেনা পরিশোধ করায় বারবার পেমেন্ট এগেইনেস্ট ডকুমেন্টের (পিএডি) মাধ্যমে ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। ফোর্সড ঋণও শোধ না করায় বারবার পুনঃতফসিলের মাধ্যমে মেয়াদি ঋণে পরিণত হয়েছে। এভাবে নন-ফান্ডেড থেকে বিপুল পরিমাণের ফান্ডেড ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় ঋণ নবায়নের কোনো সুযোগ নেই।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm