চুরি থামছেই না কর্ণফুলী গ্যাসে, নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোরই ‘দুই নাম্বারি’ বেশি
প্রতিমাসেই ‘সিস্টেম লস’ ২০ শতাংশ
চট্টগ্রামে নিরবে চলছে গ্যাস চুরি। গত বছর প্রায় ২৫০০ অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ভিজিল্যান্স টিম। এর থেকে জরিমানা হিসেবে আদায় হয়েছে ৫০ কোটি ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার ৯৪১ টাকা।
মূলত ভিজিল্যান্স টিম ও কেজিডিসিএলের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বেশিরভাগ শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠান রাতে চুরি করে গ্যাস ব্যবহার করছে। আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পখাতে গ্যাস চুরি বন্ধে ভিজিল্যান্স টিম গঠনের পরও প্রতিমাসে প্রায় ২০ শতাংশ সিস্টেম লস হচ্ছে।
এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগের ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দিনেরবেলা গ্যাসের চাপ কম থাকে। ফলে রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজ সারতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
কেজিডিসিএল সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গ্যাস পাওয়া যায় ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ২২০ থেকে ২২৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে সিস্টেম লসের পরিমাণ প্রায় ১৭ থেকে ২০ শতাংশ।
আরও জানা গেছে, ২০১০ সালে কেজিডিসিএলের ভিজিল্যান্স টিমের অভিযানে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় গ্যাস চুরির ঘটনা ধরা পড়ে। আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প খাতে গ্যাস চুরি বন্ধে আগে ১১টি ভিজিল্যান্স টিম কাজ করলেও বর্তমানে রয়েছে ১২টি টিম।
চায়ের দোকান থেকে শুরু করে নামি-দামি শিল্প প্রতিষ্ঠান—কেউই গ্যাস চুরিতে পিছিয়ে নেই। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস চুরির দায়ে অর্থদণ্ড ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে মেসার্স জেএম ইন্ডাস্ট্রিজ, জেমিনি ফ্যাশন, ক্যাফে কদম হোটেল, ইসলামাবাদ সল্ট রিফাইনারি ইন্ডাস্ট্রিজ, মেসার্স রহমান অ্যালুমিনিয়াম প্রোডাক্টস, কেএস সল্ট, মেসার্স লিজ ওয়াশিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মোস্তফা সিএনজি, কেওয়াই সিআর কয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, কনফিডেন্স সল্ট লিমিটেড, একেস ফ্রাইড রাইস মিল, মক্কা মুড়ি মিলস, সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ, এমপি স্পিনিং মিল, মেঘনা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, কেডিএস কটন পলি থ্রেড ইন্ডাস্ট্রিজ, কেডিএস প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মোস্তফা ভেজিটেবল, আম্বিয়া সল্ট, শাহ আমানত সিটিজি টেক্সটাইল, মেসার্স বায়েজিদ স্টিল, হোটেল জামান, বেঙ্গল ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ, এইচআরসি লেদার, মাস্টার স্টিল রি-রোলিং মিল, মীর পাল্ট অ্যান্ড উড ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিয়ং মিল, কর্ণফুলী সিএনজি ফিলিং স্টেশন, আলমাস সিএনজি, বাগদাদ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউনুস ফিলিং স্টেশন এবং নোয়াপাড়া সিএনজি স্টেশন।
এর মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই সীতাকুণ্ড, নাসিরাবাদ ও কালুরঘাট শিল্প এলাকার। গ্যাস চুরির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে গ্যাস চোর সিন্ডিকেটের তোপের মুখে পড়েন প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন এমডি প্রকৌশলী সানোয়ার হোসেন চৌধুরী। নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় একটি স্টিল মিলের গ্যাস চুরি ধরে সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও জরিমানা আদায় করায় তাকে চট্টগ্রাম ছাড়তে হয়েছে।
এছাড়া মিটারে অবৈধ হস্তক্ষেপ, বাইরে থেকে তার ঢুকিয়ে মিটারের ব্লেডের ঘূর্ণনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, মিটারের লিড সিল কেটে ডিজিট ঘুরিয়ে কারচুপি, একটি বয়লারের স্থলে দুটি বয়লার স্থাপন, শিল্প কারখানা ও ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতে অনুমোদিত ক্ষমতার চেয়ে বেশি ক্ষমতার জেনারেটর ব্যবহার, অননুমোদিত বার্নার ব্যবহারসহ নানাভাবে গ্যাস চুরি ও অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছে চোরের দল।
অভিযোগ আছে, ভিজিল্যান্স দলের সদস্যরা এবং কেজিডিসিএলের সেলস ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভিজিল্যান্স ডিপার্টমেন্টসহ বিভিন্ন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রাহকদের গ্যাস চুরিতে সহায়তা করে। এছাড়া কোম্পানির পক্ষ থেকে যাদেরকে ৮টি জোনে ভাগ করে চুরি ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারাই সন্ধ্যায় অভিযানের নামে মিল-কারখানা থেকে গ্যাস চুরির মাসোহারার টাকা নিয়ে আসে।
চট্টগ্রামের পটিয়া লবণ কারখানা, কালুরঘাট, নাসিরাবাদ ও সীতাকুণ্ড শিল্প এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন রি-রোলিং মিল, লবণ কারখানা ও পেপার মিল থেকে এই চক্র লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে গ্যাস চুরি বন্ধে ভিজিল্যান্স টিমের তৎপরতা থেমে নেই বলে দাবি করছেন কেজিডিসিএল কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানের কারণে বদলে গেছে কেজিডিসিএলের চিত্র। শুধু সংযোগ বিচ্ছিন্ন নয়, অপসারণ করা হয়েছে বড় বড় অবৈধ গ্যাসলাইন।
চট্টগ্রাম নগরীর খোয়াজনগর, কর্ণফুলী, হালিশহর, পতেঙ্গা ও সিইপিজেড এলাকায় কেজিডিসিএলের ভিজিল্যান্স টিম অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৩৫২ ফুট অবৈধভাবে স্থাপিত পাইপলাইন অপসারণ করেছে।
গ্যাস চুরি বন্ধ না হওয়ার বিষয়ে কেজিডিসিএলের জিএম মো. মতিউর রহমান (রাজস্ব) বলেন, ‘এই বিষয়ে আমার কিছু বলা বারণ আছে। আপনি (প্রতিবেদক) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলুন।’
ডিজে