২০১৮ সালে চাঁদা চেয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনায় সাবেক ৬ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। মামলা দুটি দায়ের করেছেন চুয়েটের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মাহমুদুল ইসলাম এবং জামিল আহসান।
মামলা দুটির আসামিরা হলেন—সৈয়দ ইমাম বাকের, মো. সাখাওয়াত হোসেন ওরফে সম্রাট, অতনু মুখার্জি, নিলয় দে, মো. মেহেদী হাসান ফরহাদ ও মোহাম্মদ ফখরুল হাসান ফাহাদ। এছাড়া অজ্ঞাত দেখানো হয়েছে আরও ২০-৩০ জন আসামি।
জামিলের মামলার এজহার থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের জুলাইয়ের শুরুতে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা বাকের ও সম্রাট জামিলকে কল দিয়ে শিবির নেতা বলে আখ্যা দিয়ে ও প্রাণের নিরাপত্তা বাবদ পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে অপারগতা জানালে তারা জামিলকে হত্যারও হুমকি দেয়। জামিল তখন ক্যাম্পাসে ছিলেন না বলে জানায়।
পরে ওই বছরের ১৯ জুলাই জামিল চুয়েটে পরীক্ষা দিতে আসলে পরীক্ষার পর তাকে ঘেরাও করেন বাকের, সম্রাটসহ অন্য আসামিরা। তারা তাকে লাথি, কিল-ঘুষি মারতে মারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ অফিসে নিয়ে যায় এবং বাথরুমে আটকে রাখে। ২ ঘণ্টা পর আসামিরা জামিলকে বের করে লাঠি, রড ও স্ট্যাম্প দিয়ে আবারও মারতে থাকে। এক পর্যায়ে জামিল বেহুশ হয়ে পড়েন।
জামিলের জ্ঞান ফিরে তারা আবারও তাকে মারতে থাকে। একপর্যায়ে জামিলের হাতে লম্বা ছুরি তুলে দিয়ে মোবাইলে ছবি তুলে সন্ত্রাসী পরিচয়ে পুলিশে দেয়। প্রায় ৩ মাস পর কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পান জামিল।
মামলার বিষয়ে জামিল বলেন, আমাকে যখন নির্যাতন শেষে পুলিশে দিতে চাইছিল, তখন বাকের বলেছিল হাসিনা কমপক্ষে আরও ১০ বছর ক্ষমতায় থাকবে। অর্থাৎ তারা এটা ভেবেই আমার ওপর নির্যাতন ও অন্যায়ভাবে মামলা দিয়েছিল যে, এর জন্য কখনোই তাদের জবাবদিহি করতে হবে না।
তিনি বলেন, আমার মামলা করার উদ্দেশ্যও ঠিক এই জায়গাতেই। আমি চাই না ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে কেউ কখনও আর আমার প্রিয় ক্যাম্পাসে কাউকে নির্যাতন করুক। ভবিষ্যতে কেউ নির্যাতন করতে চাইলে যেনো তার মাথায় আসে, এর আগেও একদল সন্ত্রাসী চুয়েটে এরকম জঘণ্য কাজ করেছিল আর ভেবেছিল, এর জন্য কখনোই তাদেরকে জবাবদিহিতা বা বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্রের বিপরীতে আল্লাহরও পরিকল্পনা থাকে। এতোদিন ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে অন্যায়ভাবে নিজেদের অনুগত করে রেখেছিল বিধায় আমি মামলা করতে পারিনি।
অপরদিকে মাহমুদুলের দায়ের করা মামলা থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের মে মাসে বাকের তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। মাহমুদুল তখন অসুস্থতাজনিত কারণে বাড়িতে থাকায় বাকেরের কথা কানে নেননি। কিন্তু ১৯ মে বাকের তার দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু হলের ১০২ নম্বর রুমে হামলা চালায়। সেখানে মাহমুদুলকে না পেয়ে তারা তার সার্টিফিকেট, কম্পিউটার হার্ড ডিস্ক ইত্যাদি লুটপাট করে নিয়ে যায়। পরে মাহমুদুল তার মালামাল ফেরত পাওয়ার জন্য ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন। তৎকালীন ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. জিএম সাদিকুল ইসলাম মাহমুদুলকে সমঝোতার পরামর্শ দেন। মাহমুদুল প্রাণনাশের ভয় নিয়ে মালামাল উদ্ধারের জন্য পাহাড়তলীর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তৃতীয় তলায় তার এক বন্ধুকে নিয়ে প্রবেশ করেন। সেখানে ছাত্রলীগ তাদের ধরে মারধর করে ও মাহমুদুলের কাছে তার বাবার নম্বর খোঁজে। মাহমুদুল তা দিতে অস্বীকার করলে তাকে আরও মারধর করা হয়। তখন বাকের হকিস্টিক নিয়ে তার হাতে ও পায়ে সজোরে আঘাত করতে থাকে। বাধ্য হয়ে মাহমুদুল তার বাবার নম্বর আসামিদের দিলে তারা কল করে। তার বাবা এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পাঠানোর আশ্বাস দিলে তারা মাহমুদুলকে ছেড়ে দেয় ও কাউকে কিছু বললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। পরে মাহমুদুল টাকা জোগাড় করতে না পারায় চুয়েট ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন ও তাদের ভয়ে যথাসময়ে ছাত্রজীবন শেষ করতে পারেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদুল বলেন, এই ঘটনার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে আমার জীবনে। তারা আমার রুম থেকে সকল গ্রেডশিট নিয়ে যায়। যা তুলতে আমার অনেক দুর্ভোগ পেতে হয়। ক্যাম্পাসে ঢুকলেই পিছু করত, বলতে গেলে কোনো ক্লাস-পরীক্ষা ভালো করে দিতেই পারিনি। যতদিন তারা ক্যাম্পাসে ছিল, ততদিন আমি আর ক্যাম্পাসে আসিনি। আমি মনে করি, ভার্সিটি প্রশাসন একজন ছাত্রের যথাযথ সুরক্ষা দিতে অপারগ ছিল—এমনকি নিতান্ত আসল ঘটনা কি, প্রশাসন তা জানার পরও তাদের ভয়ে নির্যাতিত ছাত্রদেরকেই অপরাধী হিসেবে দোষ দিয়েছিল। পূর্বের তদন্ত কমিটিও সকল সত্য জানার পরেও তাদের পক্ষ থেকে আমিসহ সকল ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধেই যেন তদন্ত করে গেছে। তাই আমিসহ ভুক্তভোগী সকল শিক্ষার্থীর ন্যায়ের কথা চিন্তা করে আমার মামলা করা।
এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত ছয় ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
জেডএস/ডিজে